গতকাল( কাগজে কলমে গত পরশু অর্থাৎ ২ রা সেপ্টেম্বর ২০১৯) অনেক অনেক দিন পরে, হঠাৎ করে রাত পৌনে বারোটার নাগাদ লোডশেডিং হল। হ্যাঁ, আমরা তো লোডশেডিং-ই বলি। ছোটবেলার অভ্যাস। তখন সারাদিনে কয়েকবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়া এবং আসাটা নিয়ম ছিল।আর সেই আসা-যাওয়ার গল্পের ‘এক- কথায়- প্রকাশ- করো’ নাম ছিল ‘লোডশেডিং’ । বেশ কিছুবার এমনও গেছে যখন দিন দুয়েক টানা বিদ্যুৎ সংযোগ থাকেনি। না, সেই সময়ে ঝড়-বৃষ্টি-সাইক্লোন-বন্যা কিছুই হয়নি। তবুও আমরা সেই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছি। পরে কলকাতা শহরে এসেও লোডশেডিং -এর মুখোমুখি হয়েছি কয়েকবার। আজ থেকে বছর ১৩-১৪ আগে যখন পাটুলিতে বসবাস করতে এলাম, তখন এখানেও বেশ নিয়ম করেই লোডশেডিং হত। একটা এমারজেন্সি লাইট ও কেনা হয়েছিল। সঙ্গে দুটো শৌখিন টর্চ। ক্রমশঃ অদরকারে এবং অব্যবহারে লাইট এবং একটা টর্চের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটেছে। আরেকটা টর্চ, যেটার চেহারা প্রায় জিরো ফিগার মডেলদের মত, কোনো এক রহস্যময় ক্ষমতায়, বোধহয় চীন থেকে আগত বলেই, আজও টিমটিম করে তার এল ই ডি আলো জ্বালাতে পারে। কিন্তু তাকে আর দরকার পড়ে না। টর্চের প্রয়োজন আজকাল মেটায় মোবাইল ফোন। আধুনিক অ্যাণ্ড্রয়েডে একখানা অতি-বিরক্তিকরভাবে-উজ্জ্বল টর্চের বন্দোবস্ত আছে। তার আলো প্রচুর, কিন্তু ওই ফ্যাটফেটে সাদা আলো জ্বেলে মধ্যরাতে অন্ধকার ঘরে লেপের নিচে লুকিয়ে গোপন গল্পের বই পড়ার আনন্দটা নেই। এই সাদা আলো বড্ড কেজো এবং আনরোমান্টিক। এই অবধি পড়ে কোনো সবুজ পাঠিক বা পাঠক অবশ্যই মনে মনে ভাবতে পারেন- এই শুরু হল- আমাদের হ্যান ছিল, ত্যান ছিল...।সে আর কী করা যাবে! আধবুড়ো হয়ে গেছি, সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় ‘এইট্টিজ কিড’, নিজেদের শৈশব-কৈশোর নিয়ে হাহুতাশ করব এটাই স্বাভাবিক।
যাইহোক, কারেন্ট যখন গেল, তখন আমি মন দিয়ে টিভিতে ‘হানি আই ব্লিউ আপ দ্য কিড’ দেখতে দেখতে চা খাচ্ছিলাম। রাত পৌনে বারোটার সময়ে কেন চা খাচ্ছিলাম তার কোনো রোমাঞ্চকর উত্তর আমার কাছে নেই। দুম করে আলো চলে যাওয়ায় প্রথমে খানিক হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম। অন্যদিকে ল্যাপটপের স্ক্রিনটা বাইপাসের ধারের অসহনীয় উজ্জ্বল হোর্ডিং-এর মত জ্বলজ্বল করছে। খানিক ভেবে প্রথমে সেটাকেই বন্ধ করলাম। তারপরে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ঘোর অন্ধকারে মোবাইল স্ক্রিন দেখতেও বিরক্তি লাগছে। সেটাও বন্ধ করলাম। ধীরে ধীরে একটা ফূর্তির অনুভূতি এল। চারদিক অন্ধকার, বৃষ্টিও প্রায় থেমে গেছে, কিন্তু বেজায় গরম, তার মধ্যে জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি আকাশটা অদ্ভূত সাদাটে। বারন্দায় চলে গিয়ে ঘোলাটে সাদা আকাশের পশ্চাৎপটে আমার বারান্দাবাগানের গাছের পাতাদের নিকষ কালো দোদুল্যমান আলপনা, অনেক দূরের বহুতলের মাথায় জ্বলতে নিভতে থাকা একচক্ষু রাক্ষসের চোখের মত লাল আলো, আবাসনের দৈর্ঘ্য প্রস্থ জুড়ে ঠক ঠক আওয়াজ করে লাঠি ঠুকে হাঁটাহাঁটি করা রক্ষীদের মাথার ওপর ঢাউস রঙিন ছাতার অবয়ব আর ছাতার নিচে মোবাইলের সাদা আলোর ঝলকানি, সব কিছু দেখতে দেখতে আর চা খেতে খেতে মনের আনন্দে চাট্টি বর্ষার গান গেয়ে ফেললাম। মনে পড়ল, এবছর একদিনও আমি আমার বর্ষাকালের প্রিয়তম গান, কিশোরকুমারের গলায় ‘রিমঝিম গিরে সাওন/ সুলঘ সুলঘ যায়ে মন শুনিনি’- কারণ এ বছর শ্রাবণমাসে একদিনও সেইরকম ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তন হতে হতে যদি শ্রাবণে বৃষ্টি হওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শ্রাবণ আর বৃষ্টির গল্পবলা গানগুলোর তাৎপর্য কেমন থাকবে, ভাবলাম খানিক। লোডশেডিং হলে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। শুক্লপক্ষে লোডশেডিং হলে, গরমকালে আমাদের পাড়ার ছোট-বড় সবাই বাইরে বেরিয়ে পরে হই-চই আড্ডা শুরু হয়ে যেত। অন্ধকারের মধ্যেই কুমির ডাঙা খেলাও হত। পূর্ণিমা রাতে কাঁচা রাস্তাগুলি ফ্যাকাশে ফিতের মত বিছিয়ে থাকত ; সেই মায়াবি রাস্তায় নির্ভুল সাইকেল চালিয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফিরত ছায়া ছায়া কেজো মানুষের দল। বছর দশেক আগে, এইরকম লোডশেডিং হওয়ার পরে, আমার বাড়ি থেকে মিনিট কুড়ির দূরত্বে নিজেদের বাড়িতে মায়ের কোলে শুয়ে আমার বন্ধু সোমার ছোট্ট ছেলে আমার সম্পর্কে চরম উদবেগে তার মা’কে প্রশ্ন করেছিল- “অন্ধকারে মানির একা একা ভয় করবে না?” অন্ধকার বারান্দায় বসে দিগন্তের রাগী রাগী লাল লাল চোখগুলোকে দেখতে দেখতে সেকথা মনে পড়ল - একলা মানি একা বাড়িতে অন্ধকার হলে ভয় পেতে পারে - এমন ভয় পাওয়া সেই আদুরে, নরম মনের বালকটিকে মনে পড়ল। এখন তার মুখে হাল্কা গোঁফ-দাড়ি, সে মানিকে লম্বায় ছাড়িয়ে গেছে।
আর ওই ঘোলাটে সাদা আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, নাগরিক সভ্যতা প্রকৃতিকে ঠিক কতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে সবসময়ে, আলোক-দূষণ ঠিক কাকে বলে।পৃথিবীর বুকে, ওই মাঝরাতেও এত আলো জ্বলছে, যে সেই আলোর প্রতিফলনে রাতের আঁধার কেটে গিয়ে সাদাটে হয়ে গেছে। সময় কত জানা না থাকলে ঊষাকাল বলে ভুল হতে পারে। রাতের বেলা এত আলো জ্বলা কি উচিত? পশুপাখি-কীট-পতঙ্গ-গাছেরদের অসুবিধা হয়না? আমরা তো বন্ধ ঘরে পর্দা টেনে ঘুম দিই। বাইরের আলো যাতে সকালে সহজে না ঢোকে তাই পর্দা টানটান করে টানা থাকে। পশুপাখিদের কি রাতে এত আলোতে ঘুম হয়? বিশ্রাম হয়? কিংবা গাছপালাদের? গাছেরা এমন আলো দেখে ভুল করে অসময়ে তাদের রান্নাঘর খোলার ব্যবস্থা করে না তো?
মিনিট কুড়ি বিদ্যুৎ সংযোগ বিহীন হওয়াতে এত কথা মনে হল। না হলে হত না। আমরা কাউকে নিয়েই চিন্তিত নই সে অর্থে। যে যার মত শুধুই নিজেদের নিয়ে, নিজেদেরটুকু নিয়ে চিন্তিত। তবে এটাও ভেবে দেখলাম যে, রাস্তায় আলো না থাকলে, যদি বিষাক্ত সরিসৃপে অন্ধকারে কামড় দেয়, তাহলে দায় কার? কিংবা চোর-ছিনতাইবাজ যদি আমার সর্বস্ব কেড়ে নেয়, তাহলে? শেষ ট্রেনে যাঁরা বাড়ি ফেরেন, কিংবা প্রথম ট্রেন ধরতে বেরোন, তাঁদের যাওয়া-আসার পথে আলো না থাকলে চলে? মানুষের জীবনের দাম কি কাক-শালিখের ঘুমের থেকে কম?
এইসব প্রশ্নের উত্তর নেই। কাক-শালিখ-গাছপালা তো অনেক দূর, আজকের দিনে তো একদল মানুষ অন্য বহু বহু মানুষের জীবনের দরদাম ঠিক করছে। সেসব মানুষের জীবনের দাম অনেক কম, বা নেই বললেই চলে। তারা ফালতু, অপ্রয়োজনীয়। কারা আমাদের এমন ভাগাভাগি, বাছাবাছি করার অসহনীয় দুর্দম সাহস দেয়? তারও কোনো উত্তর নেই। কিংবা থাকলেও সে উত্তর কোনো এক অনন্ত কৃষ্ণপক্ষীয় লোডশেডিং এর অন্ধকারে ডুবে আছে।
হঠাৎ-আঁধারের যাবতীয় রোমাঞ্চ একসময়ে তিরোহিত হওয়ার পরে আবিষ্কার করলাম, প্রায় আধাঘন্টা মত হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক মতে ২ তারিখে পেরিয়ে ৩ তারিখ শুরু হয়ে গেছে; এবং এরপরে আর কখন সংযোগ ফিরবে বোঝা যাচ্ছে না। মনুষ্যজীবন সংক্রান্ত যাবতীয় দার্শনিক অস্তিত্ববাদ ঝেড়ে ফেলে কাজে লাগা উচিত এবার- রাতের খাওয়ার পরে রান্নাঘর পরিষ্কার করা হয়নি, মশারি না টাঙালে রাতে আতঙ্কবাদী মশারা ছেঁকে ধরতে পারে ইত্যাদি প্রভৃতি হিসেবনিকেশ হয়ে গেল। অতএব, চটপট কিছু মোমবাতি জ্বালিয়ে ফেলে পরিবেশকে যথেষ্ট রকম জাগতিকভাবে রোমাণ্টিক বানিয়ে ফেললাম। মোমবাতি বড় মনোরম এক ব্যাপার, অবশ্যই সেলাই-ফোঁড়াই, চাল-ডাল বাছা বা সুদকষা প্র্যাক্টিস করার মত জটিল কাজ না করতে চাইলে। মোমের নরম আলোয় সেসব করা যায় না তা নয়, কিন্তু সে বড় কষ্টকর। অতঃপর দিনের বাকি পড়ে থাকা সাংসারিক কাজেকর্মে মনোনিবেশ করলাম।
তবে তার আগে মোবাইল বাগিয়ে মোমেদের কয়েকখানা ছবিও তুলে ফেললাম। সোশ্যাল ভগমানেরা বলেছেন- দুনিয়ার সবকিছুর ছবি তুলে ফেল আর পোস্ট করে ফেল। রোজ রোজ ছবি দিয়ে পোস্ট করলে আবার ‘কনভারসেশন স্টার্টার’, ‘ভিজুয়াল কম্যিউনিকেটর’- এইসব গাল্ভরা ভার্চুয়াল উপাধি পাওয়া যায়। অন্যদিকে ছবি না দিয়ে লেখা পোস্ট করলে, যতজনের ফিরে চাইলে তুমি মনে মনে খুশি হবে, তার দশ শতাংশও চাইবেন না। যে যুগের যা নিয়ম। তাই ছবি সহ এই আলো-আঁধারি লেখা পোস্ট করলাম।
পরিশেষে, যাঁদের আদৌ কিঞ্চিৎ কৌতূহল হয়েছিল, তাঁদের জানিয়ে রাখি, আমার অন্ধকারে ভূতের ভয় করেনা। আমি অন্ধকারে ভরা মানুষদের অনেক বেশি ভয় পাই।