( বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ দীর্ঘ, আশঙ্কিত এবং সমাধানবিহীন পোস্ট)গত সপ্তাহে বৈদ্যবাটিতে, গঙ্গার ধারে যখন পিসতুতো ভাইয়ের বিয়ের আনন্দে হইচই করছি আর দেদার ছবি তুলছি, এমন সময়ে, সল্ট লেক সেক্টর ফাইভের এক প্রথমসারির তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত আরেক ভাই জানাল, তার অফিসে সোমবার থেকে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' জারি করা হয়েছে। এতদিন চীনে আছে, জাপানে আছে, ক্রুজ শিপে আছে, ইতালিতে আছে করতে করতে করোনা ভারতেও এসেছে এসেছে হচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে এই খবরে একটু অবাক হয়েছিলাম বৈকি। কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি। রবিবার দিব্যি লোকাল ট্রেনে ভীড়ভাট্টার মধ্যে কলকাতায় ফিরলাম। বিয়েবাড়ির অনিয়মের ফলে শরীর একটু গোলমাল করাতে সোম-মঙ্গলবার খানিক ঝিমিয়েই ছিলাম। চার-পাঁচ দিন একেবারেই কাজকম্মো করিনি, সেসব শুরু করার চেষ্টা করছি সবে।এরই মাঝে আমলা মায়ের বিলেত ফেরত ছেলের কলকাতা অভিযান শেষে যে সামগ্রিক আতঙ্ক এবং উত্তেজনা তৈরি হল, তার রেশ ধরে ফেসবুকে, হোয়াটস্যাপে, টিভি চ্যানেলে খবরের পর খবর,মেসেজ-ভিডিও-মীম্‌স্‌-এর বন্যায় কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলেছি। প্রাথমিক ঘোরটা কাটার পরে ঠাণ্ডা মাথায় স্থির করার চেষ্টা করছি কী কী করা উচিত, কেন করা উচিত বা উচিত নয়। গত বুধবারে প্রথমেই মা-বাবাকে ফোন করলাম। একেবারেই বাড়ির বাইরে বেরোতে নিষেধ করলাম। দুজনে সবে গরম পড়ায় আবার বিকেলবেলা হাউজিং এর ভেতরে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। আপাতত যে দুটি মেয়ে রান্না এবং অন্যান্য কাজগুলি করে সাহায্য করে, তারাই মা-বাবার ভরসা। এবং আমাদের ভরসা। বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে বিয়েবাড়ির গল্প করতে যাওয়ার থেকে আমরা নিজেদের বিরত রেখেছি। দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি বেশ কিছুদিন কিন্তু যাওয়ার পরিকল্পনা স্বেচ্ছায় বাতিল করেছি। গুচ্ছের লোকের সঙ্গে মিলেমিশে, নিজেরা ট্রেন-বাসে ফিরেছি, নিজেদের অজান্তেই শরীরের ভেতরে ঘাপটি মেরে ঢুকে বসে যে নেই সে, এমন কথা হলফ করে বলতে পারি কি? তাই দুই বুড়োবুড়ির সঙ্গে যাবতীয় কথাবার্তা,নির্দেশ, মান-অভিমান, বকাবকি- সবই ফোন মারফত চলছে। অধুনা পরিস্থিতিতে, করোনা বাদ দিয়ে অন্য কোনও অসুবিধার জন্য কোনও হাসপাতালে যাওয়াটা আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে খুব নিরাপদ মনে হচ্ছে না। তাই হঠাৎ করে পড়ে যাওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যদি সম্ভাব্য সমস্ত গোলমাল যাতে না ঘটে, সে বিষয়ে বারংবার খুব সাবধানে থাকতে বলা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার নেই।এরপরে যেটা মনে হল সেটা হচ্ছে গাদাগুচ্ছের বিদেশ এবং অন্য রাজ্যবাসী বন্ধু, আত্মীয়, ভাই বোনেদের খোঁজ নেওয়া। কারোর ছেলের স্কুলে ছুটি দিচ্ছে না, কেউ অফিস ট্যুরে যেতে বাধ্য- নিজের গাড়ি করে যতদূর যাওয়া যায়। কেউ হাসপাতালে যথেষ্ট ট্যিসু এবং স্যানিটাইজার পাচ্ছে না ( এটা দেশে না, বিদেশে)। কারোর বাজারে দুধ আর আটা নেই। একজনকে বললাম, অত দূর দেশে একলা আছিস, সাবধানে থাকিস। সে দার্শনিক উত্তর দিয়ে মুচকি হেসে জানাল, এখন তো একলাই থাকতে বলছে! একজন জানাল, এমনিতে কিছু মনে হয় না, কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোনো বারণ বলেই নিজেকে কেমন বন্দী মনে হচ্ছে। সদ্য বিবাহিত ভাইটি ভাগ্যক্রমে সস্ত্রীক নিজ কর্মভূমিতে পৌঁছে জানাল, সে দেশে বলেছে আগামি পনেরো দিন বাড়ি থেকে বেরোলেই জেলে পুরে দেবে। অন্তত দুইজন খুব পরিচিত মানুষ বিদেশ থেকে এসে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী রয়েছেন,এমন ও জানলাম। না, এঁরা বিলেত ফেরত ছাত্রটির বিষয়ে জানার পরে এই সিদ্ধান্ত নেন নি, আগেই নিয়েছেন।এর পাশাপাশি সারা পৃথিবী থেকে, বিশেষ করে ইতালি থেকে একের পর এক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে, যেখানে দেখছি গৃহবন্দী মানুষেরা কেমন ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট ছোট বারান্দা থেকে একা বা একসঙ্গে গান গাইছেন, একজন গাইলে আরেকজন বাজাচ্ছেন, একে অপরকে হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন। আবার চীন থেকে আসছে সেখানকার নার্সদের ছবি। উওহানের নার্সরা পনেরো ষোলো ঘণ্টা ধরে বিশেষ মাস্ক আর চশমা পরে থাকার দরুণ তাঁদের মুখে গভীর ক্ষতের মত দাগ হয়ে গেছে। কাজের সুবিধার জন্য লম্বা চুল কেটে ফেলে ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। গর্ভনিরোধক পিল্‌স্‌ খেয়ে খেয়ে পিরিয়ড্‌স্‌-এর তারিখ পিছিয়ে দিচ্ছেন এক মাসের ও বেশি, যাতে কাজ করতে সুবিধা হয়। একটি প্রতিবেদনে বিশদে পড়লাম চীন সরকার কীভাবে নিজেদের যাবতীয় পরিকাঠামো ব্যবহার করে এই মহামারীকে আপাতত নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে পেরেছে। অন্যদিকে ব্রাজিলের বাসিন্দা এক বন্ধুর পোস্ট থেকে জানলাম, সেখানকার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, যারা বাড়ি থেকে কাজ করবে, তাদের মাইনে অর্ধেক কেটে নিতে। বিশ্বজুড়ে যত দেশ এই মূহুর্তে করোনার কবলে সব থেকে বেশি আক্রান্ত, তাদের মধ্যে ইরানের অবস্থা সম্ভবতঃ সবথেকে শোচনীয়। তবে বিশ্ব রাজনীতির হিসেব মেনেই, ইরান কিন্তু ইতালির মত নিয়মিতভাবে আমাদের ফেসবুক টাইমলাইনে দেখা দিচ্ছে না। আফ্রিকাতে করোনা সবে ঢুকতে শুরু করেছে। আফ্রিকার দেশগুলি কতটা খবরে আসে সেটা আগামি দিন বলবে। এর বাইরে, করোনা নিয়ন্ত্রনে গোমূত্র পান থেকে গো-সন্তানদের বচন হয়ে ফেজ টুপির উপকারিতা, এমন বিবিধ উচ্চমার্গীয় বিষয়ে দুই লাইন লিখে নিজের জীবনে অকারণ অশান্তি ডাকতে চাই না।এই রাজ্যে আপাতত এখনও আমার ব্যাঙ্ক কর্মী বোন মাস্ক এবং গ্লাভস পরে পরিষেবা দিতে বাধ্য। অন্যান্য অনেক আত্মীয়বন্ধু যাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথাবার্তা হতে পারেনি এখনও, নিশ্চয় নিয়মিত অফিস কাছারি করছেন। চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত সর্বস্তরের চেনা এবং অচেনা মানুষদের কথা আলাদা করে বলার কিছু নেই। তাঁদের ভরসায়া আমরা আছি। অগুন্তি ধন্যবাদও যথেষ্ট নয়। গত কয়েকদিনে দেখতে পাচ্ছি, রাজ্য সরকারের তরফ থেকে কতরকমের কাজ করা হচ্ছে, বা অন্তত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গতকাল থেকে অনেকগুলো খবর দেখলাম,বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা WHO এর নিয়ম মেনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানাচ্ছেন এবং বিলি করছেন। এঁদের সবার জন্য আলাদা করে থালা বাজাই বা না বাজাই, আন্তরিক কুর্ণিশ জানাই।এঁরা যদি একদিকে থাকেন, তাহলে অন্যদিকে যাঁরা আছেন, তাদের দুটি নমুনাকে স্বচক্ষে দেখেছি।একজনকে আজ দেখেছি পাড়ার মোড়ের বাজারে ফুচকা খেতে। না, বাচ্চা কেউ নয়, আমারই বয়সী একজন মহিলা। আর একজনকে গত মঙ্গলবারে দেখেছি মোড়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা খেতে খেতে - সম্ভবত ফল খেতে খেতে- রাস্তার ধারে থুতু ফেলতে। আমি সিগন্যালে আটকা, গাড়ি থেকে নামতে পারছি না, কিন্তু তার দিকে চেঁচিয়ে যখন ভুলটা ধরাতে চাইলাম, সে আমাকে এবং অন্যদের দেখিয়ে বাকি ১০-১৫ সেকেন্ডে মুখ থেকে আরও কিছু ত্যাগ করে অবলীলায় হেলতে দুলতে চলে গেল।আশেপাশে যারা ছিল তাদেরও বিশেষ কিছু মনে হল না , যা বুঝলাম। এরাই মনে করছে, রবিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী আকাশ থেকে গ্যাস ছড়িয়ে ভাইরাস মারবেন; কিংবা পিতজা-পাস্তা খেলে করোনা হয় কিংবা গোমূত্র খেলে সেরে যায়।এদিকে, বার বার হাত ধোওয়ার আগে এবং পরের যে পারমুটেশন-কম্বিনেশন, সেটা বড় জটিল। বিভিন্ন লেখালিখি পড়ে যেটুকু বুঝলাম এতদিনে, নভেল করোনা ধাতু, কাপড়,প্লাস্টিক, কাঠ ইত্যাদি র ওপরে দিব্য কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েকদিন অবধি থাকতে পারে। এর মানে হল, আমি যদি আজকে বাড়ি ফিরে এসে হাত ভাল করে ধুয়েও নিই, এমন হতেই পারে যে তিন দিন আগেই আমার হাত মারফত সে আমার ল্যাপ্টপ কী বোর্ডে জাঁকিয়ে বসে আছে। শুধুই কি কীবোর্ড? তেমন করে ভাবলে তো বসার ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র প্রতিদিন স্যানিটাইজ করতে হয়। বাজার করে নিয়ে এলাম যে থলি, সেটাকেও সাবান দিয়ে কাচব কি? কিংবা ঘরের কাজে সাহায্য করে যে মেয়েটি, সে চলে যাওয়ার পরে কি আবার দরজার বাইরে ভেতরে মুছব? সারাদিন ধরে এই অংক কষতে হলে বাকি কাজ করব কখন? গত মঙ্গলের পর আজ বাজার যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। বেরোনোর একটু পরেই স্বাভাবিকভাবেই গলা খুশখুশ করতে শুরু করল, যেমন আমার সারা বছর করে থাকে। কিন্তু বেশ বুঝতে পারলাম, মনে দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে। দোকানের ছেলেটি আমাকে এক ট্রে ডিম কেনার অফার দিতে সরাসরি আন্দাজ পেলাম লোকজন কী পরিমাণে অকারণে বেশি বাজার করছে। ওষুধ আসে যে অ্যাপ মারফত, সেই সংস্থার ছেলেটি দুপুরে কিছু ওষুধ দিতে এসে জানাল, একেকজন নাকি পাঁচ ছয় মাসের ওষুধ এক সঙ্গে কিনে নিচ্ছে। আমাকে নিজের দরকারি ওষুধটা পেতে হলে, অ্যাপের দিকে তাক করে বসে থাকতে হবে দিনভর,সেখানে ওষুধে দেখা দিয়েই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। একেকজন যদি পাঁচ ছয় মাসের ওষুধ কিনে বসে থাকে, তাহলে তারা কালোবাজারীর থেকে কম কীসে?ব্যক্তিগতভাবে , আতঙ্কে আছি। নিজেদের জন্য, কাছের দূরের প্রিয়জনেদের জন্য, চেনা-অচেনা সমস্ত মানুষের জন্য। বেশ আতঙ্কে আছি ---মনের অবস্থা প্রায় হলিউডের নীলচে-ছাই ঘোলাটে রংবিন্যাসে তৈরি সুপারহিট অ্যাপোক্যালিপ্টিক ছায়াছবির আবহসঙ্গীতের মত। এককালে অমন ছবি দেখে ভাবতাম,আমরা বেঁচে থাকতে থাকতে এ জিনিষ হবে না। গত কয়েক বছরে জানি, হবে, সব হবে। কিন্তু এ ও জানি, ওই নীলচে-ছাই ঘোলাটে রং-এর ওপর কিছু উজ্জ্বল ,ঘন রঙের প্রলেপ দিয়ে ক্যানভাসের প্রকৃতি বদলে দেওয়া চেষ্টাটা অন্তত করা দরকার। সবাই মিলে, একা একা চেষ্টা করলে সেটা হয়ত সম্ভব।

https://www.facebook.com/mahaswetasmusings/photos/699935293877684