বাবাকে নিয়ে এই লেখাটি , স্বাভাবিকভাবেই, অতিদীর্ঘ। পড়তে অনেকটাই সময় যাবে।
হিন্দুস্থান কেব্ল্স্ হাই স্কুলের কাজ থেকে বাবা অবসর নেন ২০০০ সাল নাগাদ।
বাবা কিছুদিন পরে ঠিক করলেন কম্পিউটার শিখবেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক মানুষ হিসাবে এই যন্ত্রটি সম্পর্কে বাবার স্বাভাবিকভাবেই ঔৎসুক্য ছিল। তাঁদের কর্মজীবনকালে নানাবিধ কারণে এই রাজ্যে কম্পিউটার আসতে আসতেও আসেনি, সেটা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে দুঃখিত ছিলেন। আমি ততদিনে অল্প বিস্তর মাল্টিমিডিয়া শিখে চাকরি করছি, ভাই ওয়েব ডিজাইন শিখে কাজ করছে, এবং সে নিজের উপার্জনে একখানা ডেস্কটপ কিনে ফেলেছে। তাই শুধু কম্পিউটার নয়, ইন্টারনেট নিয়েও স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর প্রশ্ন ছিল। তো একবার বাড়ি ফিরে শুনলাম বাবা কম্পিউটার ক্লাস করতে যান, কিন্তু খুবই অপছন্দ সেই ক্লাস। কালো স্ক্রীনের ওপর সাদা দিয়ে খালি cd, md ইত্যাদি লিখতে হচ্ছে, ছবি আঁকা বা নানারকম কায়দা লেখা-টেখা কিছুই করা যাচ্ছেনা। বুঝলাম বাবাকে ঘাড়ে ধরে DOS শেখানো হচ্ছে। বেজায় জ্ঞানী মুখ করে বাবাকে বলে এলাম, শুরুতে ওইসব শিখতেই হবে, চাও বা না চাও। বাবা বেজায় বিরক্ত ছাত্র, কিছুদিনের মধ্যেই সেই ক্লাস ছাড়লেন।
আমি আর ভাই এক সঙ্গে কলকাতায় আমার বড়মামার ফাঁকা ফ্ল্যাটে থাকি, রেঁধে বেড়ে খাই আর অফিস করি। ভাই ফ্রিল্যান্সিং করবে বলে ডেস্কটপটা কিনেছিল। কাজ যে কত করত সে আমার খুব মনে নেই, ছুটির দিন থাকলে একেকদিন বেজায় 'রোডর্যাশ' খেলত সেটা আমার মনে আছে। সেই ডেস্কটপে 'ফোটোশপ' ইন্স্টল করা ছিল। বাবা 'ফোটোশপ' - এর কাজকম্মো দেখে বেজায় উৎসাহিত হয়ে ফোটোশপ শিখে ফেলতে চাইলেন। কিন্তু ওই সাতদিনের দেখা করতে আসার ফাঁকে, নিজেরা সারাদিন ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফিরে, আধা ঘন্টার জন্য কাউকে ফোটোশপ শেখানো যায় না বোধ হয়। ভাই চেষ্টাই করেনি যতদূর মনে পড়ে, আমিও দিন দুয়েক ফোটোশপে একটা ফাইলে 'লেয়ার' কেন থাকবে বোঝাতে না বোঝাতেই বাবা-মায়ের ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। তবে বাবা যাওয়ার আগে আমাদের বলে গেলেন, তোরা বেজায় বাজে টিচার, কিছুই শেখাতে পারিস না।
এরপর মাঝে কিছুদিন কেটে গেল। আন্দাজ ২০০৪-২০০৫ সালের আশেপাশে চিত্তরঞ্জন-রূপনারায়ণপুর অঞ্চলে মোবাইল পরিষেবার জন্য টাওয়ার বসল। পুরোটাই স্মৃতি থেকে লিখছি এবং আন্দাজে লিখছি, কারণ বছরে দুইবার বা তিনবার বাড়ি ফিরলে একটু একটু উন্নতি দেখতাম। মনে আছে ২০০৫ সাল নাগাদ বাড়ি গিয়ে যখন দেখলাম মোবাইল ব্যবহার করা যাচ্ছে, বন্ধ করে রখতে হচ্ছে না, বড়ই পুলকিত হয়েছিলাম সন্দেহ নেই।
২০০৭ সাল নাগাদ একদিন বাবা আমাকে বললেন, একটা কম্পিউটার কিনব ভাবছি--- কীরকম কেনা উচিত, বল দেখি। আমি ততদিনে আমার প্রথম ল্যাপটপের মালিক হয়েছি। ছুটিতে বাড়ি গেলে ল্যাপটপের ক্রসবডি কাঁধে ঝুলিয়ে যাই। সঙ্গে থাকে ইউ এস বি ডঙ্গল। বাবা মাঝেমধ্যে টুকটাক প্রশ্ন করেন,এটা কী, সেটা কেন। এবং আমি তখন ভাবছি যে পুরনোটাকে বাতিল করে নতুন একটা ল্যাপটপ নিতে হবে। তাই বাবাকে বললাম, তুমি বরং আমার পুরনোটা ব্যবহার করো, আমাকে তো একটা নতুন নিতেই হবে। তো সেই রফা হল। কয়েক মাস বাদে, সম্ভবতঃ ২০০৭ এর পুজো কিংবা শীতের সময়, নিজের নতুল ল্যাপটপ কিনে, পুরনোটা বাড়িতে দিয়ে এলাম। বাবাকে ইমেইল খুলে দিলাম, ইন্টারনেট বিষয়ে নিজে যেটুকু বুঝি সেটা বোঝালাম, গুগলে কীভাবে সার্চ করতে হয় শেখালাম। এম এস ওয়ার্ড নিয়ে বাবা ধন্ধে রইলেন, তাই নোটপ্যাড ব্যবহার করে কীভাবে টাইপ করতে হয় শেখালাম। এদিকে আমরা তখন 'অর্কুট'- এ মগ্ন। প্রথম সোশ্যাল মিডিয়ার আস্বাদ গ্রহণে ব্যস্ত। বাবা 'অর্কুট' নিয়েও উৎসাহ দেখিয়েছিলেন, তবে শেষ অবধি অর্কুটে অ্যাকাউন্ট খোলেন নি। কিন্তু 'উইকিম্যাপিয়া' নিয়ে বাবার প্রবল আগ্রহ ছিল। আকাশ থেকে স্যাটেলাইটের চোখ দিয়ে নিজেদের চেনা অলি-গলি-রাজপথ-কুটির-প্রাসাদ দেখার এক অদ্ভূত আনন্দ ছিল। আমি ডঙ্গল নিয়ে বাড়ি গেলে আমরা 'অমুকের বাড়িটা দেখি তো', 'তমুক জায়গাটা দেখি তো' করেছি বেশ কয়েকবার।
২০০৭ সালে বাংলাদেশকে তছনছ করে 'সিদ্র্' নামের এক সাইক্লোন। সেই সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাবনা শহর , যেখানে ছিল আমার বাবার ঠাকুরদাদার বিস্তৃত পরিবার---আমাদের আদি পৈতৃক ভিটে--- যেখানেও কেটেছিল শৈশবের অনেকটা সময়। বাবার কথায় সেইসময়ে আঁতিপাতি করে পাবনা জেলা শহর খুঁজেছি, খুঁজেছি পাবনার 'রূপকথা' সিনেমা হল। বাবা বলেছিলেন, খবরে বলছে ওখানে নাকি সব কিছু ধুয়ে মুছে গেছে, আমার স্মৃতি দুর্বল হয়ে আসছে, আমার ছোটবেলার সব স্মৃতি যদি হারিয়ে যায় তাহলে কী হবে? আমাকে উইকিম্যাপিয়া থেকে পাবনার একটা ভালো ম্যাপ প্রিন্ট করে দিস । খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার এটাই যে, ২০০৭ সালে যেখানে উইকিম্যাপিয়াতে কল্যাণগ্রামের মত ভারতের নেই-শহরের বাড়িঘরের 'বার্ড্স্ আই ভিউ' পরিষ্কার পাওয়া যেত, তখনও বাংলাদেশের এক জেলা শহরের ছবি ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ অবধি পাবনার ম্যাপ আর আমাদের দেখা হয়নি। ভেবেছিলাম বাবাকে বাংলাদেশের একটা বিস্তৃত ম্যাপ কিনে দেব, সেটাও আরও অনেক না করার মত করা হয়ে ওঠেনি। সেই সময়ে বাবাকে বলেছিলাম, তুমি বাংলাদেশ যাবে? নিজে গিয়ে দেখে আসবে কেমন আছে তোমার বাড়ি? তাহলে পাসপোর্ট বানানোর চেষ্টায় লাগি। কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন, গিয়ে যদি দেখি সব বদলে গেছে... থাক বরং।
২০০৮ সাল আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক বছর। বছরের শুরুর দিকে কোনো একদিন আবিষ্কার করলাম ইউনিকোড বাংলাকে মান্যতা দিচ্ছে সমস্ত প্রধান ব্রাউজারগুলি। ইউনিকোড বাংলা টাইপ করার জন্য --- কীভাবে আজ আর মনে নেই--- খুঁজে পেলাম অভ্র কীবোর্ড। এই সফটওয়্যারটি নির্মাণ করার জন্য এবং এটিকে ওপেন সোর্স রাখার জন্য ডঃ মেহেদী হাসান খানের কাছে আপামর বাঙালির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিছুদিন টুকটাক প্র্যাক্টিস করেই বুঝে গেলাম, অভ্রের সাহায্যে, বিশেষ করে ওয়েবে, বাংলায় টাইপ করা অতি সহজ। আমার মত মানুষদের জন্য, যারা আগে অন্য কীবোর্ড লেআউট বা সফটওয়্যার-এর সাহায্যে বাংলায় টাইপ করা অভ্যাস করেন নি, এটা একটা বিরাট সুবিধা হল।
২০০৮ সালের পুজোর সময়ে অক্টোবর মাসে, সম্পূর্ণ ইউনিকোড প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকাশ হল 'ইচ্ছামতী'-এর প্রথম সংখ্যা। একেবারে অপরিচিত মাধ্যমের পুরোটা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলেও, সৃজনশীল একটা কাজ করব ভেবেছি, তাই এই অবাণিজ্যিক অকাজে বাবা এবং মায়ের পুরো সমর্থন ছিল। যেকোনো নতুন কাজের প্রথম উদ্যমের উচ্ছ্বাসে, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বছরের ছয়টা করে সংখ্যা প্রকাশ করব, দুই মাস অন্তর। সেই পণ পরের বছর থেকেই আর রাখতে পারিনি। সেটা অন্য গল্প। কিন্তু অক্টোবরের পরের ডিসেম্বরে ইচ্ছামতীতে নতুন বিভাগ সংযোজনের লক্ষ্যে শুরু হল 'আন্মনে' বিভাগ। বাবাকে বললাম, তোমার একেবারে ছোট্টবেলার গল্প লেখো। ততদিনে বাবাকে বাংলায় টাইপ করা শিখিয়ে দিয়ে এসেছি। আমাদের কল্যাণগ্রামের বাড়িতে ইন্টারনেটের সংযোগ নেওয়া হয়ে গেছে। বাবা মাঝে মাঝেই আমাকে ইমেইল করেন টুকটাক, মূলতঃ অভ্যাস বজায় রাখার জন্য। ইচ্ছামতীর ২০০৮ এর ডিসেম্বর / শীত সংখ্যায় শুরু হল বাবার বাংলাদেশে শৈশব কাটানোর স্মৃতিকথা - 'আমার ছোট্টবেলা'। মোট আটটা পর্বে, প্রায় দুই বছর ধরে বাবা লিখেছিলেন একেবারে ছোটবেলার, দশ বছর বয়সে হঠাৎ করেই কলকাতায় চলে আসার আগে অবধি জীবনের গল্প। কিন্তু অনেক বলেও বাবাকে দিয়ে কলকাতায় আসার পরে, শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের গল্পগুলো লেখাতে পারিনি। এখন বুঝি, বাবার কাছে এক দুইবার খুব অল্প শুনেওছি, বেশি একেবারেই বলতে চাইতেন না, মনে করতে চাইতেন না---কোনোমতে নৌকা এবং ট্রেনে চেপে, সেনা-পুলিশ ইত্যাদির ধরপাকড় পেরিয়ে পোঁটলা পুঁটলির মত কলকাতা শহরে এসে পড়াটা স্বাভাবিকভাবেই দশ বছরের এক বালকের কাছে সুখকর ছিল না।
২০০৯ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত ইচ্ছামতীর তৃতীয় সংখ্যা ( ২০০৯ সালের বসন্ত সংখ্যা) থেকে বাবা ইচ্ছামতীর বিজ্ঞানবিষয়ক বিভাগ 'পরশমণি'- এর নিয়মিত লেখক হয়ে ওঠেন। বাবার পুরনো ছাত্রছাত্রী এবং হিন্দুস্থান কেবল্স্ এর পরিচিত জনেরা জানেন, বাবা ওখানে বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকাতে নিয়মিত বিজ্ঞানবিষয়ক নিবন্ধ লিখতেন - সম্ভবত বাবা-ই একমাত্র লিখতেন। কিন্তু সেগুলি হত বড়দের জন্য লেখা। তাই বাবা ইচ্ছামতীতে লেখার ব্যাপারে শুরুতে একটু দ্বিধায় ছিলেন। প্রথমে বললেন, আমি যা জানি সেসব অনেক পুরনো বিষয়। এখনকার পত্রিকাতে লিখলে কে পড়বে? আমি বললাম, আমার বুদ্ধি বলে, বিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ দুনিয়ার সবাইকেই নিতে হয়, আর সেইসব তত্ব বছর বছর বদলায় না। তুমি সেইসবই লেখো; যেভাবে মাঝেমধ্যে পাড়ার নানা অনুষ্ঠানে ছোটদের ওয়ার্কশপে গিয়ে নানা বিষয় নিয়ে বলে আসতে সেভাবেই লেখো। তারপরে এল অবধারিত প্রশ্ন- লিখব যে, কে পড়বে? বাবাকে বললাম, কেউ না পড়ুক, আমি পড়ব। তুমি শুরু তো করো। একটা ছোটদের পত্রিকা করার চেষ্টা করছি, সেখানে একটা বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিভাগ থাকবে না? আর তুমি লিখলে আমি অন্তত এটুকু বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকব যে ভুল তথ্য যাবে না।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল অবধি, বাবা নিয়মিত ইচ্ছামতীর 'পরশমণি' বিভাগে, অত্যন্ত সরল ভাবে , প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ছোট ছোট নিবন্ধ লিখেছেন। ২০০৮-০৯ সালে বাবাকে দিয়ে লেখা শুরু করালেও, আমিও খুব নিশ্চিত ছিলাম না কে পড়বে, কেন পড়বে। মনে মনে আশা রাখতাম--- আজও যখন যেকোনো নিষ্ঠাভরে সৃজিত লেখা প্রকাশ করি--- একই আশা রাখি, এটা পড়ে কেউ একজন অন্য রকম ভাবতে শিখুক, নতুন কিছু জানুক। যদি ইচ্ছামতীতে প্রকাশিত একটা লেখাও একজনকেও নতুনভাবে ভাবনার খোরাক যোগায়, আর সেটা যদি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে না হয়েও, অনেক পরেও হয়, তবুও তো হবে। ২০২০ সালে এসে সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কত সহজ হয়ে গেল। গতবছর যখন রাতারাতি সবাইকে অনলাইন পড়াশোনা করতে শিখতে হল, এবং হয়ত সেই কারণেই বাংলা মাধ্যমে পড়া ছাত্রছাত্রীরাও তুলনামূলকভাবে অনলাইন কার্যকলাপে বেশি স্বচ্ছন্দ হল, বা হতে বাধ্য হল, তখন একদিন গুগল সার্চ কন্সোলের মাসিক বার্তা আমাদের জানাল যে ২০১১ সালে বাবার লেখা 'গাছেদের রান্নাঘর' শীর্ষক একটা লেখা বারবার এক বিশেষ অর্গানিক সার্চ এ জায়গা করে নিচ্ছে। সেই সার্চ এর প্রশ্ন ছিল- 'পাতাকে গাছের রান্নাঘর বলা হয় কেন?' - একাধিক ছাত্রছাত্রী স্কুল থেকে আসা কোনো প্রজেক্টের প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য এমন খোঁজ করেছিল কি? সঠিক উত্তর জানিনা। তবে একজনেরও যদি সাহায্য হয়ে থাকে, তাহলে ইচ্ছামতীতে বাবার ওই নিবন্ধটি লেখা সার্থক ।
২০০৯-২০১০ সালের মধ্যে দুটো ব্যাপার ঘটল। 'বাঙালনামা' ডিজিটাল আর্কাইভের তরফ থেকে কস্তুরি বসু আমাকে যোগাযোগ করলেন, বাবাকে দিয়ে বাংলাদেশের স্মৃতিকথা লেখানোর জন্য। কস্তুরি বসু, প্রিয়াঙ্কা রায় ব্যানার্জি, ঝুমা সেন এবং সোমনাথ রায়-এর যৌথ সম্পাদনায় 'বাঙালনামা' একটি উৎকৃষ্ট উদ্যোগ, যার উদ্দেশ্য ছিল '...to look at certain aspects of the history and social anthropology of post-colonial and post-partition Bengal in a popular, non-academic setting, and to develop a digital archive of the same.' তাঁদের উৎসাহে, বাবা 'সেই সময়ের গল্প' শিরোনামে দুই পর্বে লিখলেন নিজের সেইসব অভিজ্ঞতার কথা, যেগুলি তিনি সযত্নে এড়িয়ে গেছিলেন ইচ্ছামতীতে 'আমার ছোট্টবেলা' লেখার সময়ে। বাঙালনামাতেই বাবা লিখলেন নিজের ফেলে আসা দেশের প্রিয় বন্ধু, একটু বয়সে বড় হায়াত ভাই-এর কথা - সেই কিশোর কিংবা তরুণ যে অসমবয়সী একটি বন্ধুকে নিজের ভাইয়ের মত আগলে রেখেছিল যতদিন না তারা দেশ ছেড়ে চলে যায়। বাঙালনামাতে আরো কিছুদিন পরে , ২০১৩ সালে, নিজের স্মৃতির ওপর নির্ভর করে বাবা আরও এক বিষয়ে লিখেছিলেন -'পাবনা জেলার কথ্য ভাষা'। আমি বাঙালনামার উদ্যোক্তাদের কাছে কৃতজ্ঞ, তাঁদের উৎসাহে বাবার অম্লমধুর স্মৃতিগুলি কিছুটা হলেও নিবন্ধিত হয়েছিল, এবং ইচ্ছামতী-এর বাইরে প্রথম অনলাইনে লেখা প্রকাশিত হয়েছিল।
অন্যদিকে, সেই সময়ে, ২০০৮-২০০৯ থেকেই এপার বাংলায় একটা কম্যুনিটি ব্লগ জনপ্রিয় হয়েছিল - 'কফিহাউজের আড্ডা' ছিল তার নাম। বেশ কয়েকবছর চলে ব্লগটি, চেহারা বদলে বদলে। ব্লগের প্রধান উদ্যোক্তা/ উদ্যোক্তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অভ্র পাল। বাবা সেইখানেও লেখালিখি শুরু করলেন। কফিহাউজের আড্ডার দ্বিতীয় এডিশনে, ঠিক করা হয়েছিল কেউ গল্প বা কবিতা লিখবে না; দৈনন্দিন নানা ঘটনা লিখবে, এবং সেই লেখাও ২৫০ শব্দের বেশি হবে না। ব্লগের নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, সমস্ত ব্যবহারকারীর ইউজারনেম ঠিক করা হয়েছিল চা বা কফির অনুসঙ্গে, যেমন কোল্ড কফি, লাল চা ইত্যাদি। বাবাকে আমি নাম বেছে দিয়েছিলাম 'ভাঁড়ের চা'; একটা দুধ চা ভরা মাটির ভাঁড়ের ছবি ছিল বাবার আইকন। সেই ছদ্মনাম পেয়ে বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। নানা কাজেকর্মের ফাঁকে আমাদের বয়সীদেরই সেখানে যাতায়াত কম হত । বাবা বরং বেশি লিখতেন। আর অন্যরা লিখছে না, পড়ছে না দেখে হতাশ ও হতেন। ততদিনে বাঙালির জীবনে ঢুকে পড়েছে 'ফেসবুক'। সকালের দাঁত মাজা থেকে রাতের মশারি টাঙানো অবধি অনলাইন বাঙালি ফেসবুকে মগ্ন। কিন্তু বাবা তখনই সোশ্যাল মিডিয়ার জটিলতায় ঢুকতে চান নি। তাই অন্যরা কেন 'কফিহাউজের আডডা'-তে এসে লিখছে না, বুঝতেন না।
২০১৩ সাল নাগাদ--- সঠিক মনে নেই --- বাবা ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুললেন, অন্তত ফেসবুকে বাবার অ্যাকাউন্ট তাই বলছে। বাবাকে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে নিরস্ত করার যাবতীয় চেষ্টা বিফলে গেল। নিরস্ত করতে চেয়েছিলাম, কারণ যাবতীয় কাজের জন্যই , আমাকে সামনে থাকলে পাশে বসে কিংবা বেশিরভাগ সময়ে ফোনে ট্রেনিং দিতে হত। সেই ট্রেনিং পর্বের অডিও রেকর্ড করে রাখলে বেশ কয়েকটা ছোট স্ট্যান্ড আপ কমেডির রসদ যোগাড় হয়ে যেতে পারত। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না, বাবা ডিজিটালি সোশ্যাল হলেন। ক্রমেক্রমে ফেসবুকের হিসেব নিকেশ বুঝলেন। তারপরে একদিন আবিষ্কার করলাম, ইচ্ছামতীর সূত্রে পরিচিতদের অনেকেই বাবার ফেসবুক বন্ধুতালিকায় - নিবেদিতা, অনন্যা, যশোধরাদি, অভ্র, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য স্যান্যাল, সঞ্জীব কুমার সিন্হা। বেজায় অবাক হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম- এটা কী করে হল?এঁরা তো সব আমার চেনা মানুষ, তুমি মাঝে ঢুকলে কী করে? বাবা অম্লানবদনে বললেন, তোর বন্ধু বলে কি আমাকে পাত্তা দেবেন না নাকি? আমি ফ্রেন্ডস রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি, ওঁরা অ্যাক্সেপ্ট করেছেন।
এই করে করে ফেসবুকে বাবার 'বন্ধু'-এর সংখ্যা বাড়তে লাগল। প্রতিবেশী, পুরনো ছাত্রছাত্রী, আত্মীয়স্বজন, পুরোনো সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ হল। সঙ্গে হল একেবারে অচেনা অনেক বন্ধু। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা কম্পিউটারের সামনে বসে ঘন্টা দুই তিনেক দিব্যি কেটে যেত। ক্রমে এই সমস্ত বন্ধুত্বের সূত্রে বাবার ছোট ছোট বেশ কিছু লেখা অনলাইনে এবং মুদ্রনে প্রকাশিত হয়। নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত-এর 'মাধুকরী' তে বাবা লিখেছেন কয়েকবার। একটি সাহিত্য গ্রুপের তরফে বছর কয়েক আগে বইমেলায় একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। সেখানেও বাবার লেখা বেরোয়। সেই সংকলনের দুটি কপি কিনে আনার জন্য আমাকেই একদিন ভরদুপুরে সেক্টর ফাইভে দৌড়াতে হল।
ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বাবার একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল দ্য ক্যাফে টেবল প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত উপমহাদেশের খাদ্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিষয়ক -' নুনেতে ভাতেতে' -শীর্ষক বইতে। এই বইয়ের সম্পাদনা করেছেন ভারতের রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল ও বাংলাদেশের অনার্য তাপস।লেখাটি বাবার থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল । খুব সম্ভবত 'নুনেতে ভাতেতে'-এর 'প্রথম খণ্ড: খাদ্য সংস্কৃতি বিষয়ক সঙ্কলন' - এই রয়েছে বাবার লেখাটা। বইটা এই মূহুর্তে হাতের কাছে নেই, তাই একটু ধন্ধ রয়ে গেল।
এই বইতে বাবার লেখা বেরোনোর পরে আমি বাবাকে বললাম, এটা কী ঠিক হচ্ছে? একে বলে গুরুমারা বিদ্যে। আমার থেকে কম্পিউটার শিখলে, বাংলায় টাইপ করতে শিখলে, আমি মারফত বন্ধু যোগাড় হল, এখন আন্তর্জাতিক কোলাবোরেশনে প্রকাশিত বইতে তোমার লেখাও বেরিয়ে গেল...বলি হচ্ছেটা কী? কই, এরা কেউ আমার লেখা তো চায় না? শুনে বাবা আবার অম্লানবদনে আমাকে বললেন, তোর থেকে কেন চায়নি তার আমি কী জানি? তুই নিশ্চয় তেমন ভালো লিখিস না...বোঝাই যাচ্ছে কার লেখার দাম আছে। এমন উত্তর শুনে আমি বিরাট বড় চোখে কটমট করে তাকিয়েছিলাম, আর উত্তর দিয়ে বাবা হোহো করে হেসেছিলেন।
ছোট থেকে অনেক বড় বয়স অবধি বাবাকে মোটামুটি যমের মত ভয় পেতাম আমি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভীতি সরে গিয়ে বাবার সঙ্গে আমার এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নিজেদের মধ্যে এমন সমস্ত খুন্সুটি, তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া সবই চলত। নানারকমের মজাও হত। হয়ত কোনো নতুন সিনেমায় এমন কিছু কথা বলা হল, যেগুলি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কিন্তু স্ল্যাং বা বিদেশি, অপরিচিত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তাই বাবা ঠিক বুঝলেন না। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী বলল? আমি গম্ভীরমুখে উত্তর দিয়েছি, ওটা বড়দের ব্যাপার, তোমার বুঝে কাজ নেই। বাবা বুঝে গেলেন। মাঝেমধ্যে ফেসবুকে নিজের কিছু মতামত লিখে ফেলতেন, যেগুলি তেমন তেমন লোকের নজরে পড়লে ট্রোল্ড হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা। তখন সেগুলি কেন ফেসবুকে লেখার দরকার নেই বা উচিৎ নয়, সেটা বসে বসে বোঝাতে হত। আমার খুড়তুতো বোন প্রথমে কিছুদিন বাবার সঙ্গে ফেসবুকে 'ফ্রেন্ড' হয়ে থেকে একদিন হঠাৎ বাবাকে 'আনফ্রেন্ড' করে দিল। বাবার তাতে মহা দুঃখ - আমি কী করেছি যে ও আমাকে আনফ্রেন্ড করে দিল? আমি তো তোদের সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব রাখতে চাই। তখন বোঝাতে হল- সে একটি বছর কুড়ির মেয়ে, সে তার বন্ধুদের সঙ্গে যা যা শেয়ার করে, সেই সব কিছু তোমাকে দেখাতে চায় না, তুমি সম্পর্কে জ্যেঠু হও --- এটা তোমাকে বুঝতে হবে। ওরা যা শেয়ার করে সবকিছু আমিই বুঝিনা, তুমি কী করে বুঝবে - একেই তো বলে জেনারেশন গ্যাপ।
এমন সব ব্যাখ্যায় বাবা অবশ্য সন্তুষ্ট হন নি। নতুন জিনিষ জানার বিষয়ে আগ্রহ বরাবরই বজায় ছিল। তাই কালক্রমে একটি স্মার্টফোন ও কেনা হল। সেই স্মার্টফোন চালাতে শেখা হল। আমরা বাবাকে বললাম ,শুধু খেলা করবে বলে অকারণে একটা খেলনা কিনলে। কথাটা আংশিক সত্যি, কারণ বাবার মূল কৌতূহল ছিল এই আজব যন্ত্রের আগাপাশতলা নিজে ঘেঁটে দেখা। তাই শুরু হল প্রচুর প্রশ্ন- অ্যাপ কী? টুইটার কী? ইন্স্টাগ্রামে কী করে? হোয়াটস্যাপ -হোয়াটস্যাপ করে সবাই বলছে, ব্যাপারটা কী? এইসব প্রশ্নের সম্মুখীন হলে আমি বা ভাই প্রথমেই মুচকি হেসে বলতাম - তুমি কি এবারে ওখানেও ঢুকবে নাকি?খবর্দার , একদম যাবে না। কিন্তু ভবি সহজে ভুলতেন না। এখনও খুঁজলে দেখা যাবে বাবা ইন্সটাগ্রামে, টুইটারে, এক খানা করে অ্যাকাউন্ট খুলে রেখেছেন। তুমি ইন্স্টাগ্রামে কী করছ? বারণ করে গেলাম যে? জিজ্ঞেস করলে উত্তর এসেছে- ওই যে , স্ক্রীনে দেখাল, তুমি কি নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে চাও? তাই ইয়েস বলে দেখলাম কী হয়। এরপরে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, 'টিন্ডার' ব্যাপারটা কী বলতো ? সেদিন আমরা খুব হেসেছিলাম। ব্যাপারটা কী বোঝার পরে আর সেখানে অ্যাকাউন্ট খোলার কথা ভাবেন নি। বাবাকে বলেছিলাম তোমার এইসব অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে আমি হাসির গল্প লিখব একদিন।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনের খোলনলচে এমন ভাবে পাল্টে দিচ্ছে, অথচ বাবা নিজের প্রাইম টাইম পেরিয়ে এসেছেন - এটা বোধহয় বাবার মেনে নিতে একটু কষ্ট হত। অথচ এমন দিন যে আসবে, সেটা কিন্তু বাবার আন্দাজে অনেকদিন আগে থেকেই ছিল। হিন্দুস্থান কেব্ল্স্ এর কারখানায় তৈরি হত টেলিফোনের তার। কিন্তু সেই সংস্থারই পূজাবার্ষিকীতে আজ থেকে বোধহয় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে, বাবা এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন টেলিসংযোগ হবে অন্যভাবে। মানুষের হাতে হাতে ঘুরবে নিজস্ব ফোন। সঙ্গে নিজের শিল্পনগরীর সম্ভাব্য করুণ ভবিষ্যতের কথাও লিখেছিলেন। বাবা চলে যাওয়ার পরে এক অনেকদিনের পুরনো ছাত্র এসে গল্প করতে করতে বলে গেলেন, স্যার আমাদের ফার্স্ট বয় অমুকের সায়েন্স সেমিনারের প্রস্তুতিতে সাহায্য করছিলেন। ও যেদিন সেমিনারে গেল, স্যার ওকে বললেন , এই কথাটাও বলিস,এমন এক দিন আসবে যখন মানুষ হাতের ফোনে অন্য মানুষের ছবি দেখতে পাবে, টিভির মত। ...এখানে আমার বন্ধুরা যখন নিজেদের স্কুলের পুরনো সব গল্প করে, আমি আমাদের স্যারের এই গল্পটা সবাইকে বলি।
আন্দাজ করতে পারি, অত বছর আগেও, মফস্বলের সীমিত সংযোগ ব্যবস্থা এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও , বাবা যতটা পারতেন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থাকার চেষ্টা করতেন। আমাদের বাড়িতে একটা পত্রিকা আসত মনে আছে- 'সায়েন্স টুডে'। এছাড়াও অন্যান্য সূত্র ছিল নিশ্চয়। ইদানীং বাবার পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি, এদিক ওদিক , কোনো দরখাস্তের খসড়া কিংবা আমাদের কোনো হাতের লেখার খাতার পেছনের টুকরো টুকরো জমানো হরেক রেফারেন্স, যেগুলি দেখে বোঝা যায় পরে কোনো লেখায় ব্যবহার করা হয়েছে।
২০১৭ সালে বাবাকে একখানা ওয়ার্ডপ্রেস ব্লগ খুলে দিলাম। ফেসবুক যে আসলে আমাদের কোনো সংবেদনশীলতার ধার ধারে না, ইতিহাসের ধারাবাহিকতা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই, পুরনো লেখা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, লেখা পেলে ছবি পাওয়া যায়না, ছবি পেলে লেখা পাওয়া যায়না ( অবশ্য কিছুদিন হল এই অবস্থা একটু বদলেছে) - এই অসুবিধাটা যেদিন থেকে বাবা নিজে বুঝতে পারলেন, সেদিন থেকে দাবী উঠল- আমার একটা ব্লগ চাই। তাই জন্মদিনের উপহার হল একটা ব্লগ। বললাম, তোমার নতুন, পুরনো যাবতীয় লেখা এখানে জমিয়ে রাখো। কে এসে পড়বে, না পড়বে ভাবার দরকার নেই। নিজের মাথাকে কাজে রাখার জন্য, নিজের সমস্ত কষ্ট করে লেখাগুলিকে একত্রে রাখার জন্য এখানেই লিখবে। তারপরে ফেসবুকে শেয়ার করবে।
প্রথম কয়েকদিন বাবাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য নিয়মিত বাবার ব্লগে উঁকি দিতাম। তারপরে যা হয়, ব্যক্তিগত শতেক সমস্যায় এই নতুন কাজেও ভাঁটা পড়ে। এতদিনে লক্ষ্য করছি, ২০১৭ এর অগাস্ট থেকে ২০১৮ এর অগাস্ট- এই এক বছরের মধ্যে, নতুন-পুরনো মিলিয়ে বাবা দুইশোর কাছাকাছি পোস্ট করে রেখেছেন। বেশিরভাগই খুব ছোট, একেবারেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। তবুও, তার মধ্যেও রয়ে গেছে আমাদের অজানা কত গল্প, বাবার বড় থেকে বুড়ো হয়ে যাওয়ার পথের নানা কাহিনি।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে বাবার শরীর খারাপ হতে শুরু করে। সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে মার্চ ২০১৯- এই সাত মাসে নানারকমের দুর্ঘটনা, ক্লান্তিকর এবং আশংকাজনক অভিজ্ঞতা,একাধিক চিকিৎসকের কাছে যাতায়াত ইত্যাদির পরে আমরা জানতে পারি,বাবা যে সমস্যায় ভুগছেন তার নাম postural hypotension । বয়স, অনেকদিন ধরে একই ওষুধ খেয়ে যাওয়া, হট করে শোয়া অবস্থা থেকে বসা বা দাঁড়ানো -এমন নানা কারণে বয়স্ক মানুষদের এটা হতে পারে। কিছু ওষুধ বদলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন, খুব সাবধানে ধীরে ধীরে ওঠাবসা করতে হবে, পারলে ওয়াকার নিয়ে হাঁটতে হবে। কার্ডিয়াক সার্জন বাবাকে বলেন- আপনার হার্ট আমার থেকেও ভালো, শুধু সাবধানে হাঁটাচলা করুন। কিন্তু postural hypotension-এর কারণে বার বার পড়ে গিয়ে বাবার আত্মবিশ্বাস কমে গেছিল। সারাজীবন যে মানুষটা ডাম্বল, ওয়েট লিফটিং, জগিং, যোগাসন ইত্যাদি নিয়ে কাটালেন, বয়সকালে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেলে বেড়িয়েছেন, নিয়মিত হাঁটা বাদ দেন নি, প্রবল নিয়মনিষ্ঠ এবং পরিমিত জীবন যাপন করলেন, শরীরের ওজন দশকের পর দশক এক জায়গায় রেখে দিলেন, তিনি নিজের এই অদ্ভূত সমস্যাটাকে মেনে নিতে পারেন নি। বাবা একেবারেই গুটিয়ে গেছিলেন। অনেক বলে বলেও নতুন করে লেখালিখি করানো গেল না। মাঝেমধ্যে ফেসবুকে কিছু পোস্ট করতেন, আমি পড়ে বুঝতে পারতাম, লিখতে হয় তাই লিখেছেন- হয়ত দুইদিন আগে আমি বকেছি তাই; কিন্তু স্বেচ্ছায় অনলাইনে সক্রিয় থাকার ধারাবাহিকতা চলে গেছিল। ২০২০ এর বেশিরভাগটাই বাবা কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক থেকে দূরে সরে গেছিলেন।
২০২০-এর মার্চ এ করোনার আক্রমণ, অন্তহীন লকডাউন বাবাকে অবসাদগ্রস্ত করে তুলেছিল। ওই দুর্বিষহ বাধ্যতামূলক বন্দীদশা না হলে বাবার শারিরীক ও মানসিক পরিবর্তনের খাত অন্যদিকে বইত হয়ত। তবে আজ, এই মূহুর্তে আরেকটা লকডাউন এবং আরও অনেক বেশি বিভীষিকার মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, সেটাও হয়ত কষ্টকল্পনা। এখন আমি মনে করি, বাবা একেবারে সঠিক সময়ে চলে গেছেন। আজকের এই ফিরে আসা ভয়ানক দুর্দিন দেখতে হলনা।
মন খারাপের কথা দিয়ে শেষ করব না, মন ভালো করার কথা দিয়ে শেষ করি। ডিজিটাল দুনিয়ায় মাত্র বারো-তেরো বছরে বাবা অনেক কিছু পেয়েছেন। মা আর বাবা ২০১০ সালে নিজেদের পুরনো পরিচিত কর্মস্থল এবং বাসস্থান ছেড়ে, নিজেদের যতনে তৈরি বাড়ি বিক্রি করে কলকাতার উপকন্ঠে এসে বসবাস শুরু করেন। নতুন জায়গাতে এসে যে একাকীত্ব তৈরি হতে পারত সেটা হয়নি প্রথমত তাঁদের বর্তমান কিছু প্রতিবেশী বন্ধুর সৌজন্যে, আর দ্বিতীয়ত বাবার নিজস্ব অনলাইন কার্যকলাপের কারণে। ইন্টারনেট, ডিজিটাল প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া বাবাকে এমন অনেক ভালোলাগা দিয়েছে যেটা অন্য কোনো উপায়ে হওয়া সম্ভব ছিল না। প্রচুর পুরনো এবং নতুন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, ইউটিউবে পুরনো গান খুঁজে শোনা, পুরনো ফিল্ম দেখা, মারাদোনার সেই বিখ্যাত 'হ্যান্ড অফ গড' গোল দেখা- এসব ছিল বাবার আনন্দ। গুগলের সাহায্যে নিজের পছন্দের নানা বিষয়ে পড়াশোনাও করতেন বাবা।
বাংলাদেশের জামিরতা-গুধিবাড়ির সেই ছোট্টবেলার মামাবাড়ি, যার কথা বাবা লিখেছেন ইচ্ছামতীর পাঠক-পাঠিকাদের জন্য, সেখান থেকে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে আমার সম্পর্কে খুড়তুতো ভাই তুষার। সে বাবার মামাতো ভাইয়ের ছেলে। তুষারের মাধ্যমে বাবা ছবি দেখেছেন সেই প্রায় সত্তর বছর আগে ফেলে আসা দোতলা মাটির বাড়ির, ভিডিও কলে কথা বলেছেন নিজের মামাতো ভাইদের সঙ্গে। আরও এমন এক দুইজন আত্মীয়ের সঙ্গে বাবার যোগাযোগ হয়েছিল, যাঁদের সঙ্গে আমাদের কোনোদিন মুখোমুখি দেখাই হয় নি।
মাত্র কিছুদিন আগে ইচ্ছামতীর দফতরে একটা মেইল আসে। সেই মেইলে বাংলাদেশ থেকে একজন লেখেন, 'আমার ছোট্টবেলা'-র কোনো এক পর্বে বাবা নিজের ছোটবেলায় পড়া একটা ছড়ার চার লাইন লিখেছিলেন, সেই ছড়া নাকি তাঁর বাবাও নিজের ছোটবেলায় পাঠশালায় পড়েছেন এবং তাঁকে শোনাতেন। এই ছড়ার পুরোটা বাবা জানেন কি? বাবার হয়ে উত্তর আমাকেই দিতে হল। মন একইসঙ্গে ভালোএবং খারাপ লাগায় ভেসেছিল। একজনের কোনো একটা কথা, অন্য কার কোন স্মৃতিকে উসকে দেয়, আর কাকে নতুন করে স্মৃতিতে ধরে রাখে, সেই সূত্রে আরও কত কত স্মৃতি নির্মিত হয়, তার হদিশ আমরা কতটা রাখি?
ছোটবেলায় আমরা মাসের শুরুর দিকে একদিন সপরিবারে বাজারে যেতাম, যেদিন মাসকাবারের বাজার করা হত। আমলাদহি বাজারে ঢোকার মুখে মা আর বাবা আলাদা পথ নিতেন। মা চলে যেতেন বাজারের মাঝখানে পিন্টুমামাদের দোকানে মাসের মুদির বাজারের ফর্দ লেখাতে, আর বাবা যেতেন সবজি-মাছ ইত্যাদি কিনতে। মায়ের সঙ্গে যেত ভাই, বাবার আড়ালে মায়ের কাছে আবদার করে লজেন্স বাগানোর জন্য। আমার লজেন্স-টফিতে আসক্তি ছিল না, বরং বাবার সঙ্গে বাজারে যাওয়ার একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। বাবা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দোকানির থেকে সবজি কিনতেন, মাছ কিনতেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে আবার বাবার ছাত্র কিংবা ছাত্রের বাবা , একেকজনের সঙ্গে কতরকমের গল্প ---সেইসব আমার বড়ই পছন্দের ছিল। তাই মোড়ের মাথা থেকে মা ভাইকে নিয়ে একদিকে হাঁটা দিতেন , আর বাবা নিজের বাঁ কিংবা ডান হাতের তর্জনী আমার দিকে বাড়িয়ে দিতেন, সেই আঙুল মুঠোয় পুরে আমি বাবার সঙ্গে কাঁচাবাজারের দিকে হাঁটা দিতাম।
আজকের এই অতিদীর্ঘ লেখাটি শেষ করার পরে মনে হল, গত দুই দশক ধরে বাবার আর আমার যেন ভূমিকা বদল হয়েছিল। আমি মাঝে মাঝে তর্জনী বাড়িয়ে দিতাম, আর বাবা আমার সেই আঙ্গুল ধরে ঘুরে বেড়াতেন ডিজিটাল দুনিয়ার অলিতে-গলিতে।
Facebook Link: https://www.facebook.com/photo?fbid=10160156221272494&set=a.252427762493