গতকাল দুপুরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে গেছিলাম , সেখানে গত মাসখানেক ধরে চলছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবির এক প্রদর্শনী। প্রদর্শনীটি এই সপ্তাহেই শেষ অবশ্য। ওবিন ঠাকুর, ছবি কেমন করে লিখতেন দেখার সুযোগ পেলাম। আমি শিল্প বিশেষজ্ঞ নই, তাঁর শিল্পকর্ম বিষয়ে খুব কিছু পড়াশোনাও নেই। যেটুকু বুঝলাম, নানা ধরণের মাধ্যমে, বিশেষতঃ, জল রঙে তাঁর অবাধ স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, এবং নানা ধরণের ছবি আঁকার শৈলী তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রয়োগ করেছিলেন। ছবিগুলির বিষয়বস্তুও বিচিত্র - পোর্ট্রেট, ল্যান্ডস্কেপ, পশুপাখী, গল্পের সাথে অলঙ্করন, নাটকের দৃশ্য- নানান বিষয়, নানান শৈলীতে আঁকা- জলরং, পেন্সিল, কালি, চারকোল, তেল রঙ, সবেরই ব্যবহার করেছিলেন তিনি। কিছু কিছু ছবির রঙ এখনো এত উজ্জ্বল, যে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম, প্রায় একশো বা তারও বেশি বছরের পুরনো রং-এর গুণমান দেখে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এটাই, সরকারি জায়গা বলেই হয়ত, পুরো ব্যাপারটাই অগোছালো। ভালো করে আলোর ব্যবস্থা নেই, একেকটা ছবিতে এমনভাবে ঘরের ওপরের দেওয়ালের সাদা আলোর প্রতিফলন হচ্ছে যে, সেই ছবিটাকেই দেখা যাচ্ছে না। প্রদর্শনী ঘরে কোথাও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে কোন তথ্য নেই, লেখা বা লিফলেট, কিছুই নেই। ব্যাপারটা যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে যাঁরা দেখতে আসবেন, তাঁরা সবাই পন্ডিত এবং/ অথবা অবনীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ! কিন্তু সেরকম তো না-ও হতে পারে, তাই উদ্যোক্তাদের (এক্ষেত্রে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল এবং সরকার) এই নিয়ে ভাব উচিত ছিল। তাছাড়া কতগুলি বিভিন্ন সেটের ছবি ছিল, সেগুলি কোন গল্প বা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আঁকা, সেইসব তথ্য দেওয়া থাকলে যাঁরা দেখতে যাচ্ছেন, তাঁদের দেখার অভিজ্ঞতাটা আরেকটু ভাল হয়।
তবে এই ধরণের ভাবনাচিন্তা লালফিতের বাঁধা ফাইলের ভেতরে থাকবে,বা সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে, সে আশা করাটা হয়ত একটু বাড়াবাড়িই বটে ! না হলে কি আর ক্যামাক স্ট্রীটের দিশি নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরণী রাখা হয় ??
যাইহোক, যেহেতু টিকিট কেটে মিউজিয়ামে ঢুকেছি, তাই বাকি ঘরগুলিকেও একটু দেখে নিলাম- অনেকদিন আগে একবার গেছিলাম, তাই মনেই ছিল না ভিতরে কি আছে। চতুর্দিকে এত অযত্নের ছাপ, পুরনো অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি রাখা সেখানে আলমারিগুলির ভেতরেও পুরু ধুলো। কোথাও পুরনো হয়ে যাওয়া ধাতুর ফলকগুলি এত কালো হয়ে গেছে যে লেখা পড়াই যাচ্ছে না। কোথাও বড় বড় ছবির সামনে রাখা একখানা বিরাট স্ট্যান্ডিং ফ্যান ! ঘুরতে ঘুরতেই অনুভব করলাম, সাধারণ দর্শকদের জন্য এই জাদুঘরে ( বা এরকম অন্যান্য জাদুঘরেও), প্রশিক্ষিত, স্থায়ী 'গাইড' দের কত প্রয়োজন। সারা বছর ধরে, বিশেষতঃ শীতের মরসুমে, সারা বাংলা এবং অন্যান্য প্রদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিডিও-ফিল্ম-চলা-বাস বোঝাই হয়ে 'কলকাতা' দেখতে আসেন বাঙালি-অবাঙালি যে সব হাজার হাজার মানুষ, তাঁদের তালিকায় কালিঘাট- দক্ষিণেশ্বর-মনুমেন্ট- চিড়িয়াখানার সাথে থাকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। এঁদের মধ্যে প্রায় সবাই নাম মাত্র পড়াশোনা করেছেন, বেশিরভাগেরই অক্ষর পরিচয় নেই, থাকলেও যাদুঘরে ঢুকে কম আলোয় ছোট ছোট করে লেখা প্রচুর কথা পড়ার সময় বা ধৈর্য্য কোনটাই তাদের নেই। ইতিহাস-ভূগোলের সচেতনতা তো অনেক দূর-অস্ত্ ! এই মানুষগুলি ভীড় করে জাদুঘরে ঢোকেন, সেখানে যা রাখা আছে, সে সব সম্পর্কে কিছুই না বুঝে -'ইয়ে সব কা হ্যায়...' বলে বেরিয়ে চলে যান। এত কিছু রাখা, সেগুলির সম্পর্কে আলোকপাত করার জন্য একজনও নেই, শুধু উর্দিধারী কিছু পুলিশ মাঝে মাঝে বাঁশি বাজিয়ে ছবিতে হাত দিতে বারন করে দিচ্ছেন ! এর বদলে যদি দশ-পনেরো জনের একেকটা দলকে একেকজন গাইড এই বিরাট বাগান সহ প্রাসাদটির ইতিহাস বলে, পুরনো জিনিষপত্র গুলির সাথে জড়িয়ে থাকা গল্পগুলির কিছুটা অন্তত বলে দিতেন, তাহলে দেখার , জানার মনের রাখার উৎসাহ যে অনেক বেশি বাড়ত সেটা বলাই বাহুল্য। বা সবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া যায় একটা করে তথ্যপূর্ন পুস্তিকা, যেটা সেই সময়ে দ্রষ্টব্য বস্তুগুলিকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে, অথবা পরে বাড়ি ফিরেও কেউ কেউ সেটাকে উলটে পালটে দেখবেন। (অবশ্য সেটা করতে গেলে আবার টেণ্ডার ডাকতে হবে, তারপরে প্রচুর জল ঘোলা হবে, আর সেই ঘোলা জলে অনেকেই প্রচুর মাছ ধরবে- সেটা কর্তৃপক্ষ ভাল করে জানেন বলেই বোধহয় এইসব ব্যবস্থা নেওয়ার পরিশ্রম আর করেন না)
শুনেছি বিদেশি পর্যটকদের জন্য নাকি এইরকম গাইডরা থাকেন, দেশের মানুষগুলির জন্যেও থাকতে পারেন।দেশের মানুষগুলি যেন বরাবরই ফেলনা। ভারতীয় সভ্যতা কোনদিনই নিজে ইতিহাস নিয়ে খুব একটা উৎসাহী ছিল না, তাই এদেশের মানুষের ইতিহাসচেতনা এমনিতেই বড্ড কম - বাবা-মায়েরা কি আর সাধে ছেলেমেয়েদের বলেন- হিস্ট্রি-জিওগ্রাফি পড়তে হবে না , সায়েন্স আর ম্যাথ্স্ পড় ! কিন্তু কিছুটা হলেও ইতিহাসচেতনা না থাকলে কি কোন মানুষ নিজের দেশ, নিজের সভ্যতাকে যথার্থ ভালবাসা আর সম্মান দিতে পারে? নিজেকে সম্মান দিতে পারে?