সঙ্গের ছবিটা ফেসবুকের হোম পেজের টাইমলাইনে ভেসে উঠল। লেখা আছে -As long as a lady carries a book with her, she will always have company
তারপরে একটু জায়গা ছেড়ে
and a weapon.
বাক্যটি দেখে নিজের কিছু পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল, বিশেষতঃ ওই 'ওয়েপ্ন্ বা অস্ত্রের জায়গাটা ভেবে।
কলকাতায় কলেজে পড়ি। ছুটি পড়লে তুফান মেল চেপে বাড়ি যাই, আর ফেরার দিনের নির্দিষ্ট ট্রেন হল কোলফিল্ড এক্সপ্রেস, যাকে ধরতে হয় বাড়ি থেকে অন্ততঃ পঁয়তাল্লিশ মিনিট - প্রথমে হাঁটা, তারপরে বাস, তারপরে রিকশা চেপে সীতারামপুর জংশনে পৌঁছে। সকাল ছ'টা পঞ্চাশের গাড়ি ধরতে ভোর পাঁচটার ও আগে বাড়ি থেকে বেরোও! হাতে সময় নিয়ে, কারণ 'কোলফিল্ড' ধরানোর বাস যদি চলে যায়, তাহলে অগতির গতি পরের মিনিবাসের ভরসায় থাকতে হবে। কিংবা নিয়ামতপুরে বাস থেকে নেমেই তুমি স্টেশন যাওয়ার রিকশা তাড়াতাড়ি নাও পেতে পারো।
ধানবাদ থেকে আসা কোলফিল্ড এক্সপ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ঢোকে সীতারামপুরে। তারপরের বড় স্টেশন আসানসোল। আমরা আসানসোল যেতাম না, কারণ সীতারামপুর থেকে উঠলে আসানসোলে গিয়ে বসার জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা একটু বেশি। এখন কোলফিল্ড কতটা বদলেছে জানিনা, নিয়ম কানুন কী হয়েছে জানিনা, কিন্তু আজ থেকে পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে কোলফিল্ড ছিল মূলতঃ নিত্যযাত্রীদের ট্রেন। সীতারামপুরের পরে আসানসোল, রানীগঞ্জ, অন্ডাল, দুর্গাপুর - পরের দিকে পানাগড় আর সম্ভবত মানকরে- স্টপেজ হয়েছিল, তারপরে সোজা হাওড়া। বহু মানুষ প্রতিদিন ধানবাদ এবংপরবর্তী স্টেশন গুলো থেকে নিয়মিত কলকাতা আসতেন এই ট্রেনে, আবার বিকেলে ফিরে যেতেন। কোলফিল্ডে প্রতিটি স্টেশনের নিত্যযাত্রীদের জন্য অলিখিত নির্দিষ্ট কামরা ছিল, যেমন যে কোনো লোকাল ট্রেনে থাকে। সম্ভবতঃ একেবারে শেষের কামরাটা আমাদের মত বছরে হাফ ডজনবার যাতায়াত করা যাত্রীদের জন্য দয়া করে ছেড়ে রাখা থাকত। কিন্তু সেই কামরায় তো আর প্রতিবার ওঠা যেত না, বা গেলেও সহজে জায়গা পাওয়া যেত না। তাই ইচ্ছে না থাকলেও, 'ডিপি কামরাতে' উঠতে হত। কোনো কোনো বার, হয়ত ছুটির দিন, তাই পুরো পথটাই নির্ঝঞ্ঝাটে চলে এলাম জানলার ধারের সীটে বসে; আবার তার পরের বার, অন্য 'ডি পি' সহয়াত্রীরা নিজেরাই জায়গা টায়গা করে বসতে দিলেন। মূলতঃ পুরুষ অধ্যুষিত কামরায় --- এক যদি না অন্য কোনো পরিবার সহযাত্রী হয়ে যায় --- কিছুজন এমন সদয় হওয়ার কারণে আমাদের সীটের পাশেই পুরোটা পথ বিধানসভা-রাজ্যসভার অধিবেশন বসে যেত। আবার তার পরের বারই সারা রাস্তা উল্টোদিকের চারজন মধ্য বয়সী পুরুষের বিবিধ বাক্যবাণের সামনে পাথরের মত মুখ করে বসে বসে আসতে হল; তাঁরা আমার সামনেই বসে বসে আলোচনা করলেন অওরতকে বেশি পড়াশোনা করতে দেওয়া উচিত নয়, আর তাঁদের ন্যায্য ডি পি সীট আমি শুধুমাত্র জেনারেল টিকিটের জোরে আর লেডিজ হওয়ার সুবাদে কয়েক ঘন্টার জন্য কেড়ে নিতে পারি না। তিনজনের সীটে চারজন বসাটাই দস্তুর। জানলার দিকে বসার জায়গা পেলে পাঁউরুটির মত পাতলা হওয়ার চেষ্টায় ব্রতী থাকতে হত ( হাতরুটি হওয়াটা ম্যাপের বাইরে! ) ; আর প্যাসেজের দিকে বসলে কেমনভাবে বসতে হয় সেটা সবাই জানেন। তুফান মেলে মহিলা কামরায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা অবশ্যই একেবারেই আলাদা, এবং আলাদা পোস্ট দাবী করে।
তবে যাইহোক, বিবিধ গালমন্দ খেয়েও ছাত্রাবস্থায়, কোনোদিনই সীট বুক করে কোলফিল্ডে বা তুফানে চড়িনি। নিত্যযাত্রীদের সঙ্গে ঠান্ডা কিংবা গরম লড়াই চালিয়ে নিজের জন্য একখানা সীট যোগাড় করার মধ্যে এক অদ্ভূত সাফল্যের অনুভূতি আসত, লড়াই করে নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার আনন্দ উপভোগ করতাম আর সঙ্গে ফাউ ছিল বেশ কিছু অসুবিধাজনক অভিজ্ঞতাও। তবুও, ট্রেনের সীট রিজার্ভ করে যাতায়াত করার কথা আমরা কোনোদিন ভাবিইনি। তেমন ভাবে যাতায়াত করেছি অনেক পরে।
এই পরিস্থিতিতে, একবার কলকাতা ফেরার সময়ে আমার কপালে জুটলেন ওই তৃতীয় কিসিমের সহযাত্রীরা, যাঁরা অবিবাহিতা একলা তরুণী সহয়াত্রী পেয়ে খুবই বিব্রত ছিলেন। রাগ একটু বেশিই ছিল, কারণ যদিও আগে থেকে বসে থাকা দুইজন আমাকে জানিয়েছিলেন যে রানীগঞ্জ থেকে লোক উঠবে,ওটা ডি পি সীট এবং আমার বসার অধিকার নেই , তবুও আমি বিরস বদনে একদিকের জানলার ধারের সীটখানার দখল নিয়েছিলাম। বলাই বাহুল্য,রানীগঞ্জের রাজাবাবুরা উঠে নিজেদের জায়গা বেদখল হয়ে যেতে দেখে খুব রেগে গেলেন। তারপরে সেখানেই গাদাগাদি করে বসেও গেলেন। সবার দিব্যি জায়গা হয়ে গেল, কিন্তু গজগজ থামল না। আমি জানলা দিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে আকাশ পাতাল ভাবছি, ঘুম ঘুম খিদে খিদে পাচ্ছে, ঝালমুড়ি কখন আসবে ভাবছি, এমন সময়ে খেয়াল করলাম আমার জামার ওপরে একটা ছোট্ট গোল লাল আলো। একটু এদিক ওদিক দেখতেই বুঝে পারলাম ব্যাপারটা। আমার ঠিক উল্টোদিকের জানলার ধারে দুই পা ফাঁক করে প্রায় এলাকা চিহ্নিত করে বসে আছেন যিনি, তাঁর হাতে একখানা কড়ে আঙ্গুল সমান বিকিনি পরিহিতা মহিলার অবয়বের একটি চাবির রিং। সেই মহিলার শরীরের তিনটি নির্দিষ্ট স্থানে তিনটি লাল গোল পুঁতির মত এল ই ডি আলো। সেগুলিকে ইচ্ছেমত জ্বালানো আর নেভানো যায়। এই অভাবনীয় প্রযুক্তি -প্রয়োগ বিষয়ে আমার আগে থেকেই ধারণা ছিল। সেই সময়ে, অন্ধকার সিনেমা হলে নায়িকার ক্লোজ-আপ এলে, পর্দার ওপর তাঁর ঠোঁটে কিংবা বুকের ভাঁজে লাল লাল বিন্দু ফুটে উঠত, ছুটে বেড়াত শরীরের বিভিন্ন অংশে । বিবিধ বয়সী পুরুষের ক্ষণিক ভার্চুয়াল যৌন সুখের দায়িত্ব নিয়েছিল সেই ছোট্ট ছোট্ট লাল আলোগুলি। উল্টোদিকের রাওডি রাঠোরের বড়ই দুর্ভাগ্য, আমি তাই খুব বিচলিত হলাম না, খানিক্ষণ তাঁর চোখের দিকে এবং তাঁর হাতের বস্তুটির দিকে তাকিয়ে থেকে ফের জানলায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এবং বুঝতে পারলাম, আশেপাশে বসা বাকি চার-পাঁচজন প্রায় পিনপতন নৈঃশব্দ্য রেখে আমার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু কাঁহাতক জানলার দিকে তাকিয়ে বসে থাকা যায়? চেনা পথঘাট আবার চেনা যায়? আবার সঙ্গে লাল এল ই ডি এবং প্রচুর জরিপ সামলানো যায়? তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিলনা, যে সেদিকে মন দেব কিংবা তৎক্ষণাৎ লাইভ ভিডিও করে আপলোড করে দেব, বা নিদেনপক্ষে রেলমন্ত্রীকে টুইট করব!। তাই এক সময়ে, আমি পায়ের কাছে রাখা ব্যাগ থেকে একেবারে ওপরে যেটা রাখা ছিল, সেই বইটা বার করে নিলাম। সেটা কোনো গল্পের বই ছিল না, ছিল বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি থেকে নিয়ে যাওয়া একখানা মোটা রেফারেন্স বই। তার নাম হতে পারে 'A Critical History of English Literature', কিংবা অমনই গুরুগম্ভীর কিছু --- এখন আর মনে নেই । লেখকের নাম ও সায়েবি। ওপরের ছবিও সায়েবি। বইখানা নিয়ে মুখের সমান্তরালে তুলে নিলাম। কয়েক মূহুর্ত পরে অনুভব করলাম, মুখোমুখি দুটো সীটের মাঝে শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। বুঝলাম, নিজের অজান্তেই হাতে একখানা অস্ত্র তুলে নিয়েছি, নিজের চারপাশে তুলে দিয়েছি একটা অদৃশ্য বর্ম।
কিছু পরে ঝালমুড়িওয়ালা এলে তাঁর থেকে মুড়ি নিলাম, বই কোলে নামিয়ে রেখে খুব মন দিয়ে ফিনফিনে পাতলা নারকোলের ফালির সঙ্গে মুড়িমাখা খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। সেই সময়ে উল্টোদিকের কোণ থেকে প্রশ্ন এল - আমি কি ছাত্রী, নাকি চাকরি করি ?... এবং ক্রমে... কোন কলেজ? কী বিষয়? এটা কি আমার পড়ার বই? একা একাই যাতায়াত করছি? ইত্যাদি প্রভৃতি। যাবতীয় কৌতূহল এক বা দুই শব্দে নিরসন করে, মুখের সামনে আবার বই তুলে ধরার আগে বুঝত পারলাম, রাওডি রাঠোর একটু কম জায়গা নিয়ে বসেছেন, আর ধাতবসুন্দরী অন্তর্হিত হয়েছেন।
যতদূর মনে পড়ে, হাওড়ার কাছাকাছি এসে আমার সেই সহযাত্রীরা আমাকে চা-ও অফার করেছিলেন। তাঁদের শরীরি ভাষা এবং মুখের ভাষা, দুই-ই অনেকটাই বদলে গেছিল ততক্ষণে।
সেদিন ঘন্টাদুয়েক ওই বইখানা নাকের ডগায় কিংবা কোলের ওপর নিয়ে বসে থাকলেও এক বিন্দুও যে পড়িনি, বলাই বাহুল্য। ট্রেনে বসে রেফারেন্স বই পড়ার মত সুবোধ বালিকা আমি নই। তবে সেইবারের পর থেকে , অনেকদিন অবধি, প্রতিবার বাড়ি যাওয়ার সময়ে, আমি একখানা করে কিঞ্চিৎ স্থূল, এবং মলাটের ওপরে দুচারটে লম্বা-চওড়া শব্দ ছাপা ---যেমন deconstruction, post-modernism, renaissance, literary theory ---বই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে যেতাম। অনেকবারেই খুব কাজে লাগত। কোঁদল করে জায়গা যোগাড় করে বসেই মুখের সামনে খুলে ফেলতাম সেই বই, ব্যস, বাকি পথটা মোটামুটি নিশ্চিন্তে কেটে যেত। প্রতিবার এমন অস্ত্র ধরার দরকার পড়ত না অবশ্য।
ছবিঃ ফেসবুক থেকে সংগৃহীত