অবশেষে তাঁরা এসেছেন। আমাদের বাড়িতে থাকতে এসেছে্ন।কিন্তু যেখানে থাকবেন ভেবেছিলাম, সেখানে থাকছেন না। নিজেদের মত জায়গা খুঁজে নিয়েছেন। এক চড়াই-দম্পতি, সাথে নিশ্চয় গোটা তিন-চারেক কুচো-কাচা। চোখে দেখতে পাচ্ছি না, সকালবেলার গলাবাজি শুনে আন্দাজ করতে হচ্ছে।

২০১২ সালের শেষের দিকে বা ২০১৩ সালের শুরুর দিকে আমাদের একফালি বারান্দায় সকালের দিকে বড় বেশি কিচির -মিচির করে বেড়াতেন বেশ কয়েকটি সংসারী চড়াই। এই ফরফর করে উড়ে ঘরে ঢুকছেন, এই বকবক করতে করতে বেরিয়ে বারান্দার রেলিং-এ বসছেন। বাবা দেখে বললেন- ব্যাটারা বাসা বানানোর জায়গা খুঁজছে। ঠিক। চড়াই পাখি বলে কথা !' আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে...' ডায়ালগ দিয়েছিলেন শিল্পী বাবুইপাখিকে। তাঁরা যে চার তলার বারান্দায় বাসা বাঁধার কথা ভাববেন এতে আর আশ্চয্যির কী আছে ! কিন্তু ভাবলেই তো আর অট্টালিকা 'পরে থাকা যাবে না। আধুনিক ফ্ল্যাটে ঘুলঘুলি নেই, কায়দামারা কার্নিশের ফাঁক নেই, অব্যবহৃত কুলুঙ্গি নেই, তালামারা বেওয়ারিশে ভর্তি ছাদের ঘর নেই, সামনের গৃহস্থের উঠোন নেই, সেই উঠোনে ধান শুকোতে দেওয়া নেই, গৃহস্থের রসুইয়ে মাটির হাঁড়িতে পিঠে বানানো নেই...এত এত নেই যে কী আর বলি...সত্যি বলতে কী চাট্টি খড়কুটো লাগেজ নিয়ে ল্যান্ড করলুম আর চাট্টি ছানাপোনার জন্ম দিলুম- ব্যাপারটা আর সেরকম সহজ-সরল নেই।

তা দিন কয়েক সকালের দিকে তাঁদের গজর গজর শুনতে শুনতে বুঝতে পারলাম যে পছন্দসই ঘর পাওয়ার এত সমস্যা নিয়ে তেনারা বড়ই জেরবার হয়ে পড়েছেন। মানে বাস্তু আর ফেং-শুই মতে জায়গাটা আদর্শ, আলো-হাওয়া-জলের অভাব নেই, কিন্তু বিছানাটা কোথায় ফেলবেন সেটাই বুঝতে নাকাল হচ্ছে্ন কত্তা-গিন্নী-ননদ-শ্যালক। দেখেশুনে আমাদের দয়ার শরীরে দরদ উথলে উঠলো। আহা, বাছাদের থাকার জায়গা নেই, ডিম পাড়েন কোথায়? তড়িঘড়ি গড়িয়ার হাটের মাটির জিনিষের দোকান থেকে একজোড়া হাঁড়ি কেনা হল। সে বড় কায়দার হাঁড়ি। তার একদিকে একখানি দরজা-কাম-জানলা গর্ত; মাথার ওপরে সরার ছাদ। হুঁ হুঁ বাওয়া, এ কোন এমনি-ওমনি ফ্ল্যাট বা ভাড়া বাড়ি নয়, এক্কেরে থিম বাংলো ! সেই থিম বাংলো দুটিকে ভালো করে শক্ত লোহার তার দিয়ে বারান্দার গ্রীলের সাথে বাঁধা হল, সাধারণের হাতের নাগালের বাইরে, রাস্তার দিকে জানলা-কাম-দরজার মুখ রেখে- আমরা বাপু সবার সমান প্রাইভেসিতে বিশ্বাসী।

তারপরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা শুরু হল। এই বুঝি একদিন দেখব হাঁড়ির থেকে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে চড়াই বাবা ঢুকছেন আর বেরোচ্ছে্ন । কিন্তু কোথায় কী ! মাস পেরিয়ে বছর ঘুরে গেল, আমাদের একজোড়া থিম বাংলো ফাঁকা। বাইরে নোটিস ও ঝুলিয়ে দিলাম- অগ্রিম ভাড়া দিতে হইবে না, পোস্ট-ডেটেড চেক দিতে হইবে না, চুক্তিপত্রে সাক্ষর করিতে হইবে না,বারান্দায় পটি করিয়া নোংরা করিলেই আমরা বিরক্ত হইব না ইত্যাদি ইত্যাদি...কিন্তু কেউ পাত্তাই দিল না।

তারপরে বছর চারেক কেটে গেল। বাবা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেন- পাখি এসেছে? উত্তর মেলে না।

গত বছর আমাদের নতুন কাজের মেয়ে হাঁড়িগুলোকে দেখে বললো- তোমরা ভুল ভাবে ওগুলোকে বেঁধেছ। হাঁড়ির মুখ একটু নিচের দিকে করে বাঁধতে হয়, যাতে ওরা ঢুকতে বেরোতে পারে। ভেবে দেখলাম, কথাটা ঠিক হতেও পারে। আমরা হলাম গিয়ে আধা শহুরে, পশু-পাখি-গাছপালার সাথে বড়ই ওপর ওপর আলতো আলাপ। কিন্তু যে আমাদের থিম বাংলোগুলোকে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছিল, সে তো আদতে গাঁ-গঞ্জের মানুষ। সে-ও এটা জানে না? নাকি শহরের জল -হাওয়ায় তারও যত সহজ বিদ্যে-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে?

যাইহোক, যেহেতু প্রচুর অফার দিয়েও বাংলো বাড়ি দুটির স্থায়ী বা অস্থায়ী বাসিন্দা পাওয়া গেল না, তাই সেগুলিকে নামিয়ে নেওয়া হয়েছিল। একটিতে মাটি ভরে গাছ পোঁতা হল, অন্যটিকে বিশিষ্ট দ্রষ্টব্যরূপে বসার ঘরে সাজিয়ে রাখা হল।

মাত্র কিছুদিন আগে, আবার এ বছরের কিচির মিচির শুনে সেই হাঁড়িটিকে আবার বারান্দায় রাখা হয়েছিল। তার মধ্যে বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে কিছু ঘাস বিছিয়ে ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেট ও করে দেওয়া হল। এই কয় বছরের মধ্যে বারান্দার একদিকে সিলিং ঘেঁষে একটি কাজে-লাগলেও-লাগতে-পারে-এমন-জিনিষ-রাখার-জায়গা করা হয়েছে (বিশুদ্ধ বাংলায় সেটাকে 'লফ্‌ট্‌' বলে)। হাঁড়িটিকে সেই উচ্চস্থানে বসানো হল; এবার উৎসাহ অনেকটাই কম অবশ্য।

গত দিন দশেক ধরে রোজই সকালে বেজায় কিচিরমিচির শুনি। এদিকে হাঁড়ির ত্রিসীমানায় কেউ নেই; কিন্তু পরিষ্কার বুঝতে পারছি শব্দ ওদিক থেকেই আসছে। আবার আমাদের পায়ের বা গলার আওয়াজ পেলেই একেবারে 'পিন-পতন-নীরবতা' । শেষমেষ মাত্র দিন তিনেক আগে রহস্য উদ্ঘাটিত হল। বাসা বাঁধা এবং ছানাপোনার জন্ম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে নয়। কাজে-লাগলেও-লাগতে-পারে-এমন-জিনিষপত্রের পেছনে, সবার চোখের আড়ালে। বাবা-মা ফুড়ুৎ করে উড়ে বেরিয়ে আসছেন, আবার একটু পরেই গিয়ে ঢুকছেন, নিশ্চয় মুখে খাবার নিয়ে। খোকাখুকুরা সকালের দিকেই বেশি চ্যাঁচামেচি করে। বেলার দিকে খুব কমই আওয়াজ পাওয়া যায়।

সকালটা ইদানীং ভালোই কাটছে। বাড়িতে বেশ প্রাণ আছে মনে হয়। আমি বোঝার চেষ্টা করি- চড়াইদের বাড়িতে কী কী কথা হচ্ছে।

-দাও, দাও, দাও

-খাও, খাও, খাও,

-খাবো খাবো খাবো

-মা দেখো, কুট্টি আমার ভাগেরটা খেয়ে নিলো

-তোরা থামলি! দেবো সবক'টার ডানা মুলে এবার...

-মা, দাদা কিন্তু বেশি সাহস দেখাচ্ছে, বেরিয়ে যাচ্ছে বাসা ছেড়ে

-যাক না একবার...আর ফিরতে দেবো না, ওই সামনের ফাঁকা বাংলোয় একলা রাত কাটাতে হবে !

...চলতে থাকে...চলতে থাকে... ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ পড়লে আমি বাস্তবের খোলা বারান্দা ফেলে যান্ত্রিক জানালায় মনোযোগ দিতে বাধ্য হই।

শুধু ছোট্ট একটু দুঃখু আছে। আমাদের ফ্যান্সি থিম বাংলোকে কাঁচকলা দেখিয়ে, শ্রীমতী এবং শ্রী চড়াই সেই ধ্যাদ্ধেড়ে সরকারি আবাসনেই বাসা বাঁধলেন। আমার আর হাই প্রোফাইল রিয়্যাল্টর হওয়া হল না।

https://www.facebook.com/mahasweta.ray/posts/10155189295002494