বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ এই রচনা গণেশ পুজোর সপক্ষে বা বিপক্ষে লেখা নয়। মহামান্য ফেসবুকীয় জুরীমহোদয় ও মহোদয়াহণ, দয়া করে শিরোনাম দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ফাঁসির আদেশ দেবেন না। দেশত্যাগ ও করতে বলবেন না, আমার পাস্পোর্ট নাই। এছাড়াও, আপনি যদি কেজো মানুষ হন, খবর্দার এই লেখা পড়ে সময় নষ্ট করবেন না। আর যদি নিজেকে অকেজো মনে করেও থাকেন, তাহলেও এই লেখা পড়ে নিজেকে আরোও অকেজো প্রমাণ করবেন না। পোস্নো জাগতে পারে, কেউই যদি না পড়ে তাইলে আমি লিখছি কেন? এর উত্তরে আমি ফেসবুক থেকে ঝাড়া উত্তর লিখবঃ আমার দেওয়াল, আমি লিখব, তাতে কার কী? মাই ওয়াল ইজ মাই ওয়াল, নট ইয়োর ওয়াল...ইত্যাদি! আমার আগে থেকে সতর্ক করে দেওয়ার কথা, করে দিলাম, পরে দোষ দিতে পারবেনা যে, ফালতু হাবিজাবি পড়ে ভ্যালুয়েবল ৩-৪ মিনিট নষ্ট হল।
রাতের দিকে বাজার করতে গেছনু। আমাদের পাড়ার পছন্দের সবজী-বালকটি রাত আটটার পরে তার দোকান সাজিয়ে বসতে পছন্দ করে। হেব্বি বুদ্ধিমান। অফিস-করে-কেলিয়ে-পড়া জনগণকে বাড়িতে ঢোকার পথে খপ করে ধরা যায়, ঝপাঝপ আলু-পটল-বেগুন-টমেটো বিক্রি হয়ে যায়। কেউ বেশি দরাদরী করার মত উৎসাহ রাখে না। তাই তাকে ধরতে গেলে গোধূলী লগ্নে হাতে চাট্টি থলে নিয়ে বেরোলে চলে না, সান্ধ্য লগ্ন পার করে বেরোতে হয়। যাইহোক, তার কাছে দাঁড়িয়ে আলু-পটল ইত্যাদির হিসেব নিকেশ করতে করতে শুনতে পাচ্ছিলাম পাড়ার মোড় থেকে মাইকে অনর্গল ঘোষণা- বম্বে খ্যাত সিল্পি গান গাইবেন, কারা যেন বিখ্যাত নাচ করবেন ইত্যাদি পোভিতি। কেন, সেটা বলাই বাহুল্য- এটা হল মাই ফ্রেন্ড গানেশা উইক। মোড়ের মাথায় প্যান্ডেলে ইয়াব্বড় বক্রতুন্ড মহাকায় সূর্যকোটি সমপ্রভঃ হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন... ( আইব্বাশ! টিভিতে শুনে শুনে একটা লাইন গোটা ঠিক মুখস্থ করে লিখেও ফেললাম); তো সেই গণপতি বাপ্পার অনারে সাতদিন ধরে সন্ধেতে ওইসব গান বাজনা ইত্যাদির ব্যবস্থা।
এদিকে সবজী বালক ঢ্যাঁড়শ বাছতে বাছতে জিজ্ঞেস করল, "কটা বাজে বল তো? লাস্ট এক ঘন্টা ধরে বলে যাচ্ছে এই শুরু হচ্ছে..." আমি বললাম, "দাঁড়াও, আরেকটু রাত বাড়লে হবে..." বলতে বলতেই শুনি কে যেন একজন, নির্ঘাত পাড়ার মান্যিগন্যি দাদা কেউ হবেন, বেশ গেরাম্ভারি গলায় ভাষণ দিতে শুরু করেছেন, "... এই তো আজকালকার অবস্থা, সিরিয়াল শেষ না হলে কেউ আসবে না...আমাদের সময়ে এমন ছিল না, আজকাল তো ঘরে বসেই সুইগি তে বিরিয়ানি...ইত্যাদি ইত্যাদি..." ভেবে দেখলুম কথাটা ঠিকই...সিরিয়াল গুলোই তো যত নষ্টের গোড়া... তবে সুইগিটাও নষ্টের গোড়া কিনা ভাবতে ভাবতে মোড়ে গিয়ে ফল বালকের সামনে দাঁড়িয়েছি, ওদিকে প্যান্ডেলের দিকে কিঞ্চিৎ ঘুরে অর্ধেক মত মাই ফ্রেন্ড গাণেশাকে দেখেও নিলাম, তার পাশেই মঞ্চে তখন বম্বে ফেরত গায়িকা সবে গলা খুলে "...মেরি আওয়ায়ায়ায়ায়াজ হি পেহচাআআআআআন হ্যায়..." গেয়ে ফেলেছেন, কিন্তু যথেষ্ট হাততালি না পড়ায় কিঞ্চিৎ কনফিউজড গলায় জনগণকে পোশ্ণো করছেন -" কেমন লাগছে আপনাদের...?" এই সময়ে ফল-বালক কাঁদির কলা গুনতে গুনতে বলল, "লোকই নেই, হাততালি দেবে কে? ...যদি বলত ফ্রি তে খাওয়া আছে, দেখতে একবার কেমন ভীড় হয়...তিন দিন আগে থেকে লাইন লেগে যেত...।" পাশ থেকে রুটি-তড়কা দিদি যোগ দিলেন, "আজ কেউ আসে নাকি এইসব গান শুনতে...আজকে টিভিতে সারেগামা শুরু হচ্ছে এখন..."
এই, ঠিক এই কারণেই আমি বাজারে যেতে যে কী ভালোই না বাসি ! এই যে দুনিয়ার যত জ্ঞানের খবর, যত জরুরী বাইটস্ কীরকম চোখ কান একটু খোলা রাখলেই দিব্য নিজেরাই মন এবং মগজে সেঁধিয়ে যায় ! আবার সেসব থেকে কত ধরনের নতুন নতুন ভাবনা চিন্তার শুরু হয়...ওফ...বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর , সবার আমি ছাত্র!
ওদিকে ইতিমধ্যে সেই গায়িকা , কী যেন দুটো বাংলা গান গেয়েছিলেন...বিশ্বাস করুন, মনে ছিল, কিন্তু চেনা দোকানে ডিম কিনতে গিয়ে যখন দেখলাম সমস্ত ডিম ফুটপাথের ধারে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা মেকশিফট রোল-চাউমিনের দোকানে সাপ্লাই হয়ে গেছে...সব গুলিয়ে গেল। তার মধ্যে প্রথমটা খুব সম্ভবত "এই বাংলার মাটিতে মাগো জন্ম আমায় দিও..." আর তার পরেরটা আশা ভোঁশলে গাওয়া কোনও একটা দুষ্টু-মিষ্টি-ঝিঙ্কুমার্কা গান...সেটার মেমরি পুরো চাউমিনের সুতোর মত ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
যাইহোক, তারপরে একটা ব্যাপার হল - গায়িকা দর্শকদের জিজ্ঞাসা করলেন, আর কী বাংলা গান গাইব, নাকি হিন্দি? শুনেই আমার বাঙালি ইগোর কিঞ্চিৎ গোঁসা হল। বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে এটা একটা প্রশ্ন হল? বাংলাতেই তো গান হওয়া উচিত ইত্যাদি... কিন্তু তারপরেই মনে হল, এই বেচারীর ওপর চটে কী করব? গত দশ থেকে পনেরো বছরে জনপ্রিয়, মূলতঃ বাংলার সিনেমার যত গান, সবেতেই তো জগাখিচুড়ি হিন্দি কথার ছড়াছড়ি... বিশুদ্ধ বাংলা গান গাইলে অনুষ্ঠানের টার্গেট অডিয়েন্স স্টেজ থেকে নামিয়েও দিতে পারে। যাইহোক, গায়িকার ওই প্রশ্নের উত্তর আদৌ কী এসেছিল জানা নেই, তবে তিনি এর পরে গাইতে শুরু করলেন "বাঁহো মে চলে আও, হামসে সনম কেয়া পর্দা..."।
সেটা শেষ হল, তখন তিনি ধরলেন " তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই শিকওয়া তো নহি...।"
আমি টুক টুক করে হেঁটে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, লজিক্যালি এর পরে কোন গানটা গাওয়া উচিত? মানে প্যাটার্ন টা তো বেশ গোছানো... প্রথমে ওই "মেরি আওয়াজ হি..." যেটা আসলে রবি ঠাকুরের লেখা " যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে..."-এর সরল গুলজারিকরণ বলা যায়। ধীর গতির, গুড গার্ল মার্কা গান। কিঞ্চিৎ দুঃখী, আবেগপ্রবণ, ভিজে ভিজে, মাটি নরম করে দেওয়ার মত। তারপরে ওই "বাংলার মাটিতে মাগো" ইত্যাদি বলে নিজেকে বাংলা মায়ের আঁচলে বাঁধা সন্তান পোমাণ করা এবং নরম মাটিতেনিজের খুঁটি শক্ত করে বসিয়ে ফেলা। তারপরে একটা দুষ্টু মিষ্টি আশা ভোঁসলে গেয়ে পোমা্ণ করা যে বাংলা ভাষাতেও জনপ্রিয় লাস্যগীতি আছে এবং গাইতে পারি, দরকারে পোল (খুঁটি) ড্যান্স সহযোগে। এরপরেই নিজেকে আর বাংলায় সীমাবদ্ধ না রেখে সর্বজনীন পোমান করার জন্য হিন্দি গানে ডাইভ। সেটা ৯৯% সময়ে শেষ হয় "আজ কী রাত, পানা হ্যায় কেয়া, খোনা হ্যায় কেয়া ..." তে গিয়ে। তাই লজিক মেনে যখন একটা অভিসার আর একটা প্রেমের গান হল, তাই আমি ভাবছিলাম, এরপরে হয়ত গাইবে " তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র্যায়না..." কিংবা আরোও এক ধাপ এগিয়ে "চন্দা হ্যাইয় তু, মেরা সূরজ হ্যায় তু..."
কিন্তু আমার সেই যাবতীয় মান্ধাতার আমলের থিওরিকে নস্যাৎ করে দিয়ে, বম্বে ফেরত গায়িকা " তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই শিকওয়া তো নহি..." শেষ করেই ধরলেন " মেরে খোয়াবো মে জো আয়েয়েয়ে , আকে মুঝে ছেড় যায়েয়ে...!" যাহঃ বাবা! কোথায় সঞ্জীবকুমার- সুচিত্রা সেনের জ্যোৎস্না রাতের নিশ্চুপ রঁদেভু, আর কোথায় কাজলের তোয়ালে নিয়ে লাফালাফি! এক ঝটকায় দুই দশক পার ! একেবারে হাতে গরম টাইম- ট্রাভেল !
বুঝলাম, আমার সত্যিই অনেক বয়স হয়েছে। আমার বসে বসে মেগাসিরিয়াল দেখাই উচিত। একেক দিন রাতের দিকে, টিভি চালিয়ে গান শুনতে ইচ্ছে করলে সোনি মিক্সে 'র্যায়না বিতি জায়ে' নামের একটা অনুষ্ঠান শুনি। পরপর সব পুরনো হিন্দি গান দেয়। বেশ শান্তি শান্তি ভাব। একেক দিন একেক জন গায়ক, গায়িকা, নায়ক, নায়িকা, সুরকার, বা গানের লেখককে নিয়ে থীম ভিত্তিক অনুষ্ঠান হয়। পুরো পরিবেশনায় একটা গল্প থাকে। আমার জন্য ওটাই ঠিক আছে। এই বিয়ন্ড-জেন-জেড মার্কা সুপারফাস্ট কন্টেক্সট শিফট আমার মাথায় আর ঢুকবে না। ঠিক যেমন মাথায় ঢোকে না, দিনে দিনে, দিকে দিকে তেত্রিশ কোটি থেকে অনেক অনেক বেশি সংখ্যক দেব-দেবীর আরাধনা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে, আর সেই আরাধনাকে ঘিরে উল্লাস এবং অর্থব্যয় ইত্যাদির পরেও, কেন দুমদাম ব্রীজ ভেঙে পড়ে; কিংবা মানুষ মানুষকে মেরে ফেলে ; কিংবা প্রতিদিন অগুন্তি মেয়ে , এবং ছেলেরাও ধর্ষিত হয়; কিংবা একটাও দেশের টাকা লুটেপুটে খাওয়া রাঘববোয়াল আইনের জালে ধরা পড়ে না; কিংবা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়; কিংবা মিথ্যে অন্যায়ের দায়ে স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবিদের ধরে জেলে ঢোকানো হয়; কিংবা কেন আমাদের ব্যক্তিগত সব তথ্য খোলা বাজারে বিক্রি হয়...আর তার দায় কেউ নেয় না।
গণেশ নাকি নিজে বাবা-মায়ের চারদিকে সাত পাক দিয়ে বলেছিলেন, এই আমার বিশ্ব পরিক্রমা হল, এদিকে তাঁর ভক্তদের মধ্যে বৃদ্ধ বাবা-মাকে পিটিয়ে মারছে , এমন লোকের সংখ্যা তো কম নেই! সাতদিনের মোচ্ছব করতে গিয়ে গণেশের এই গপ্পোটা সবাই নিজেদের সুবিধামত ভুলে গেল।
মানে...ঈশ্বরী / ঈশ্বর আরাধনার পরিমাণ আর পরিমাপ তো দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। কিন্তু এই দীন হীন সন্তানদের কথা কী আদৌ তিনি/ তাঁরা ভাবছেন?
এত অবধি ভাবতে ভাবতে বাড়ি পৌঁছে গেলাম তো, তাই ভাবনাটা ওখানেই এসে আটকে গেল। আমি বেজায় ক্লান্ত হয়ে, জল-টল খেয়ে টিভি খুলে দেখি ...ওমা! সত্যিই তো সারেগামাপা শুরু হয়েছে ! সেখানে যারা ফাস- সেকেন হবে, তাদের গাড়ি, টাকা, সোনার গয়না- কত্ত কী দেবে ! সেসব দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে আমার মোড়ের মাথার বম্বে ফেরত গায়িকার জন্য এট্টূ দুঃখুও হল। চারদিক খোলা রাস্তার মঞ্চের সঙ্গে কী আর জী বাংলার সেটের তুলনা হয়?
আর তারপরে... কাজের পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে থাকা সত্বেও, মাঝরাত পার করে নিজের দেওয়াল জুড়ে অনেকদিন পরে, নতুন দেওয়াল লিখনের ব্যবস্থা করেই ফেললাম, কিঞ্চিৎ মরিয়া ভাবেই।