আমাদের সেই চন্দননগরের শেঠ লেনের বাড়ির একতলা থেকে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়িগুলো ছিল আজকের দিনের যেকোনো বাড়ির তুওনায় বেশ লম্বা চওড়া। আর একেবারে গোটা কুড়ি ( একটু কম বেশি হতে পারে) সিঁড়ি উঠে সোজা দোতলায় পৌঁছে যাওয়া যেত,মাঝপথে কোনো দেড়তলায় খানিক জিরিয়ে সেই সিঁড়ি ঘুরে দোতলায় উঠত না। লক্ষ্মী পুজোর দিনে সেই সিঁড়িগুলিতে মা লক্ষ্মীর পায়ের ছবি আঁকার দায়িত্ব পড়ত আমার আর মণিপিসির ওপর। জ্ঞান হয়ে থেকে মোটামুটি ক্লাস ফাইভ অবধি এই কাজ করেছি, তাই বলাই বাহুল্য, আসলে বেশিরভাগ কাজটা করত আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় মণিপিসি, আমি সঙ্গে হাত মেলাতাম।
খুব মন্দ কিছু আঁকতাম না... ধানের ছড়া আর লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আঁকার মত সহজ কাজ আর আছে না কি? কিন্তু গোল বাঁধত অন্য জায়গাতে - প্রায় প্রত্যেকবার আমাদের সেই অভাবনীয় শিল্পকর্মকান্ডের শেষ হত রাগ-অভিমান আর মাঝেমধ্যে অল্প কান্নাকাটি দিয়ে। আমার কাকুমণিই ছিলেন মূল সমালোচক বা আলোচক, মাঝেমধ্যে অন্য কাকারা, এমনকি বাবাও যোগ দিতেন। আলোচনার বিষয়টা খুবই গুরুতর--- এই নক্শাগুলো যে আঁকা হল... সেগুলির ওপরে পা দিয়েই তো মা লক্ষ্মী হেঁটে ওপরে উঠবেন, তাই সেগুলি কি যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মতভাবে বা 'আর্গোনমিক্যালি' আঁকা হয়েছে? - একবার আমরা আঁকলাম ধানের ছড়ার দুই পাশে দুটো পায়ের পাতা ; তার পরেরবার বেশি ভেবে , সিঁড়ির ধাপে ধাপে রাখা সব চটি সরিয়ে এক ধাপের বাঁদিকে আর এক ধাপের ডান দিকে জোড়া পায়ের পাতা আঁকলাম; আরেকবার একই দিকে পর পর জোড়া পা আঁকলাম।এবং প্রতিবারি এই পরিবর্তন করতাম আগের বারের সমালোচনার কথা মাথায় রেখে। তবুও প্রত্যেকবারই কাকুমণি ডেমো দিয়ে --- জোড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ির ধাপে ধাপে উঠে, বা সিঁড়ির এদিক থেকে ওদিকে লাফ দিয়ে উঠে উঠে--- কিংবা সেই ধানের ছড়ার দুই পাশে কাছাকাছি পা রেখে প্রমাণ করে দিলেন যে কোনো সবল সুস্থ মানুষের পক্ষেই অমন করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা সম্ভব নয়, তাই মা লক্ষ্মীও পারবেন না। আধুনিক ভাষায় একে 'ট্রোলিং' এবং 'লাইভ মিম' বললেও কম বলা হবে। প্রায় সময়েই এই ট্রোলিং হত যখন আমরা সিঁড়িগুলোর মাঝামাঝি অবধি পৌঁছে গেছি --- মানে চাইলেই আগেরগুলো সব মুছে আবার নতুন করে করার ইচ্ছে বা সময় নেই। অবধারিতভাবে তার পরেই আমি রেগে-কেঁদে ঘোষণা দিতাম --- আর কিছুতেই আল্পনা আঁকব না আমি। মণিপিসি বোধহয় অত রেগে যেত না, বা রেগে গেলেও কাঁদত না। সেসব মান অভিমানের পালা সাঙ্গ হলে হয়ত শেষ করতাম কাজ,হয়ত করতাম না...বড়রা কেউ শেষ করতেন।
আবার তেমন আল্পনা দেওয়ার দায়িত্ব এসে গেল আমাদের নতুন বাড়ি হওয়ার পরে। তখন আর সিঁড়ি নয়, সারা বাড়ির সব দরজার মুখে আর সিঁড়িতে আল্পনা দিতাম আমি, মাঝেমধ্যে সঙ্গ দিত ছোট্ট বোনেরা। পুজোর জায়গার আল্পনা মা-ই বরাবর দিতেন। কাকুমণির সেই ট্রোলিং-এর গল্প সবার মুখে মুখে এমন ছড়িয়ে গেছিল, যে ঠিক কাকুমণির কায়দায় এবারে আমাদের রাগাতে আসত আমার ভাই। তবে আমি সেসবে রেগে যাওয়ার, অভিমান করার বয়স পেরিয়ে চলে এসেছিলাম ততদিনে।