যখন সবে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, তখন বাবা বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ফিসফিস করে যেখানে ছাপ দিতে বলে আসতেন, তাই লক্ষ্মী মেয়ের মত দিয়ে আসতাম। মোটামুটি এরকম একটা ভয় থাকত যে কাকে ভোট দিলাম, সেটার বাইরে থেকে বসেই পাড়ার নেতারা সবাই বুঝে যাবে- ওই মহাভারতের সঞ্জয়ের স্টাইলে। তারপরে মাঝে কিছুদিন ভোট দেওয়া এদিক সেদিক বাদ পড়েছে, অফিস ছুটি করে আট ঘন্টার পথ উজিয়ে  একদিনের জন্য বাড়ি গিয়ে নিজের গনতান্ত্রিক অধিকার ফলানোর কোন ইচ্ছাই জাগেনি।  তারপরে এসেছে নতুন এক পর্ব। গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাধ্য নাগরিক এর মত লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনে, রোদের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে ভোটমেশিনের বোতাম টিপে এসেছি একটাই কারণে- যাতে আমার ভোট অন্য কেউ ব্যবহার করার সুযোগ না পায়।

এইখানে মনে হল- আচ্ছা, এরা এই ঘোর গরমে নির্বাচন ফেলে কেন বলুন তো? বেশ শীতকালে ফেলতে পারে, রোদ পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে কমলালেবু খেতে খেতে ভোট দেওয়া যেত, বেশ পিকনিক পিকনিক ভাব হত একটা।

যাকগে, কাকে কবে ভোট দিয়েছি সেটা এখন ভাল মনে নেই। চিরকালই জানতাম, আর গত বেশ কয়েক বছরে, আরেকবার নিশ্চিতভাবে বুঝেছি  স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিকের জীবনের সেই অমোঘ সারসত্য -
'দোষ কারো নয় গো মা
আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা...'

ইশকুলের বাংলা পরীক্ষায়  ভাব সম্প্রসারনে এটা এলে কি লিখতাম জানিনা; এখন হাড়ে হাড়ে জানিঃ

' আমরা নিজেরাই খাল কাটিয়া একবার কুমির, একবার জলহস্তী, একবার হাঙর, একবার তিমি ডাকিয়া লইয়া আসি। মাঝে মাঝে বকচ্ছপ, হাঁসজারু আর হাতিমি-ও ডাকিয়া লইয়া আসি। তাহারা আসিয়াই আমাদের হাতে মারে, ভাতে মারে, আগায় কাটে, গোড়ায় কাটে। তবুও আমাদের উৎসাহের শেষ নাই। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আবার করিয়া, নূতন ছদ্মবেশধারী পুরাতন শত্রু ডাকিয়া আনিয়া মাথায় চড়াইয়া লই। এবং তাহার অগ্রে, নিজেরাই কলহ-বিবাদ-বিতর্ক-মিটিং-মিছিল-আলোচনা- সমালোচনা করিয়া গৃহবিবাদ, অগ্নিমান্দ্য, মাথাযন্ত্রণা ইত্যাদিও নিজেদের জীবনে ফিরাইয়া লইয়া আসি।'

এই বছর, প্রথম দিকে ভেবেছিলাম ভোট দিতে যাব না। চতুর্দিকে যা যা দেখছি  বা শুনছি, তাতে কাউকেই ভোট দেওয়ার ইচ্ছা নেই।
তারপরে দুয়েকজন আমাকে বলল- আহা, ভোট দিতে যাবি না কেন? গিয়ে 'নোটা' টিপে চলে আসবি। নাহলে তোর ভোটে তো ছাপ্পা পড়বে। ভাবলাম ঠিক ঠিক, নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার অন্য কাউকে প্রয়োগ করতে দেওয়া উচিত না।
তার কিছুদিন পরে, ফেসবুকে দেখি এক বন্ধু দাদা লিখেছেন- নোটা বোতাম টিপে আসবে কেন? এই ধর যদি তুমি কোন নতুন জায়গায় বেড়াতে যাও, গিয়ে দেখ সেখানে সব হোটেল গুলোই পচা, এটার বিছানায় ছারপোকা তো ওটার বাথরুমে আরশোলা, আর আরেকটাতে ঘরের দরজা ভাঙা, অথচ তুমি পয়সা খরচা করে সেখানে বেড়াতে গেছ, তাহলে কি সেখান থেকে তুমি ফিরে চলে আসবে? নাকি ওগুলোর মধ্যে যেটাকে তাও কিছুটা সহ্য করা যায়, সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেবে?... তাছাড়া তুমি নিজে কি ভয়ানক ধোয়া তুলসীপাতা, যে এমন ভাব দেখাচ্ছ যেন কোনদিন কোন অন্যায় কর না?  - পড়ে ভাবলাম ঠিক ঠিক...নোটা দিয়ে কি হবে, নোটা তো পুরোটাই ভার্চুয়াল একটা ব্যাপার; আমি হলুম গে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। আমার উচিত আমার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে মোটামুটি চলনসই লোকটাকে ভোট দিয়ে আসা।

কিন্তু এইখানে এসেই আটকে গেলাম। ছোটবেলায় যখন মাঝেমধ্যে খুব পড়ে-টরে, ভাল পরীক্ষা দিয়ে, যখন রেজাল্ট বের হলে দেখতাম নম্বর মন্দ হয়নি, তখন নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এসে মা'কে আব্দার করতাম - এই তো রেজাল্ট ভাল হয়েছে, এবার একটা প্রাইজ দাও - একটা চকোলেট চাই, বা নতুন পেন্সিল বক্স চাই ইত্যাদি; আমার নিরীহ, স্নেহময়ী মা দিতেন ও কিছু না কিছু। কিন্তু আমার বেরসিক বাবা সব ফূর্তিতে জল ঢেলে দিয়ে বলতেন- ওরে, তুই হলি গিয়ে 'বেনাবনে খাটাশরাজা' বা আরো ভাল করে বললে 'কানার মধ্যে ঝাপসা', এই নম্বর নিয়ে এত নাচানাচি করার কিছু নেই। '

'কানার মধ্যে ঝাপসা'- এই শব্দবন্ধ বাংলার সাধারণভাবে তালিকাভুক্ত প্রবাদগুলির মধ্যে পড়ে কিনা আমি জানি না। এটা আমাদের পরিবারের কোন গুরুজনের সৃষ্টিও হতে পারে। এর বিস্তৃত অর্থ হল, চতুর্দিকে সবাই কানা, তার মধ্যে তুমিই একটু ঝাপসা মত হলেও দেখতে পাও। ছোট্ট মফস্বলের স্কুলে ভাল নম্বর পেয়ে অতি আনন্দিত হওয়ার কোন কারণ নেই, কারণ এখানে তোর সাথে পাল্লা দেওয়ার লোকের সংখ্যা কম। আসল জায়গায়, অর্থাৎ কলকেতা শহরে পড়াশোনা করতে গেলে দেখতে পাবি চারিদিকে তোর থেকে বেশি বেশি নম্বর নিয়ে কত ছেলে মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।কলেজবেলায় কলকাতায় কলেজে ভর্তি হয়ে সত্যিই বুঝেছিলাম, বাবার এই কথাটা কতটা সত্যি।

আজকের ভোটের প্রসঙ্গে এই কথাটা মাথায় এল, কারণ ওই ভোট দিতে যাব আর 'নোটা' বোতাম ছোঁব না, এই কথাটা ভাবার পর থেকেই মনে হচ্ছে- ভোট দিতে তো যাব, কিন্তু দেব কাকে? আমার কাছে তো সবাই কানা, এদের মধ্যে ঝাপসা কোনজন , বুঝি ক্যাম্‌নে?

আজ যত লোকের ভোট দেওয়ার কথা, তার মধ্যে অর্ধেক লোক এতক্ষণে আঙুলে বেগুনী দাগ নিয়ে ঘামতে ঘামতে বাড়ি ফিরে চলে এসেছে। আমি এখনো 'ঝাপসা' কে খুঁজে চলেছি। বেলা তিনটের মধ্যে অন্তত খুঁজে পেতে হবে। দেখা যাক...

লেখাটা এইখানেই শেষ হত, কিন্তু গতকাল সন্ধ্যেবেলা আমাদের আবাসনের একটি বছর চারেকের বালক 'ভোট'-এর এক অভাবনীয় সংজ্ঞা আমাকে উপহার দিয়েছে। সেটা না লিখলে এই লেখা অসম্পূর্ণ। তার মা জানালেন, সে নিজেই প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিয়েছেঃ

'ভোট কি?'
'দরজায় ধাক্কা দেওয়ার মানে হল ভোট।'

 

ফেসবুক লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/mahasweta.ray/posts/10154278751057494