আমার মফস্বলী ছোটবেলার একটা নিয়মিত অভিজ্ঞতা ছিল ফেরিওয়ালারা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিয়মিত আসতো, কেউ বা অনিয়মিত। পুরোনো কাপড়ের বদলে স্টিলের বাসন নিয়ে অবাঙ্গালী বাসনওয়ালি, মিশনের ধূপকাঠি নিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া সাইকেল কারখানার সেই ভদ্রলোক যাঁর চশমার কাঁচটা খুব মোটা ছিল, জয়নগরের মোয়া, তিলের খাজা নিয়ে মরসুমি অচেনা মুখ, শীতকালে শালের বিশাল পোঁটলা পিঠে নিয়ে আপেলের মত গালওয়ালা চাপদাড়ি কাশ্মীরী ছেলের দল, সন্ধ্যেবেলা টং টং আওয়াজ করে দক্ষিনী দোসাওয়ালা…এছাড়া ছিল আরো কয়েকজন। তাদের ঠিক ফেরিওয়ালা বলা যাবে কিনা জানিনা, কারন তারা ছিল নিয়মিত যোগানদার, আর আমি তাদেরকে মোটামু্টি ঘরের লোক মনে করতাম। তাদের মধ্যে প্রথম ছিল হাজরাকাকু। হাজরাকাকুর নাম জানতাম না, এখনো জানিনা, বাবারা ওনাকে ‘হাজরা’ বলে ডাকতেন, তাই উনি আমাদের সবার হাজরাকাকু। হাজরাকাকু সকাল নটা নাগাদ বাজার থেকে টাটকা মাছ তুলে সেগুলিকে একটা কাঠের বাক্সে পুরে, সাইকেলের পেছনে বেঁধে চলে আসতেন কলোনিতে। ‘মাছ- মাছ’ হেঁকে সাইকেল নিয়ে ঘুরতেন। হাঁক শুনলেই, যেদিন প্রয়োজন হত, বাবা এবং পড়শি কাকুরা বেরিয়ে দরদাম করে মাছ কিনতেন। আমরাও বেরোতাম পেছন পেছন। ঐ বাক্সটার প্রতি এবং হাজরাকাকুর প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ ছিল। কাকুর কি মজা! -পড়াশোনা নেই, সারাদিন সাইকেল নিয়ে শুধু ঘুরে বেড়ানো! কি সুখের কাজ!

তারপর ছিলেন নির্মলকাকু। বাঁকে মিষ্টির ডেকচি বসিয়ে কাঁধে করে নিয়ে আসতেন। দুই পাশে তিন-তিন ছটা ডেকচি। খুললেই রসগোল্লা, কালাকাঁদ, ছানার টোস্ট, কালজাম, মিষ্টি দই…। এই নির্মলকাকু আমার পুতুলের বিয়েতে স্পেশাল অর্ডার নিয়ে গুলির সাইজের রসগোল্লা আর মিনি সাইজ কালাকাঁদ বানিয়ে দিয়েছিলেন। এখন নির্মলকাকুর বিশাল দোকান, আর বাঁক নিয়ে ঘুরতে হয়না।
সন্ধ্যাবেলা আসতেন পাঁউরুটিওয়ালা। প্রথম দিকে যিনি আসতেন তার গাড়ীতে প্যাডেল এবং সিট ছিল। তারপর তিনি আসা বন্ধ করলে আরতে শুরু করলেন আরেকজন। তার বেশ বয়স, আর তার গাড়িতে সি্ট বা প্যাডেল ছিল না, এমনকি একটা ভেঁপু হর্ন পর্যন্ত ছিল না। তিনি মুখে মুখে হাঁক দিতেন -পাঁউরুটি-ই-ই… আমাদের কান খাড়া রাখতে হত। শুনতে পেলেই দরজা খুলে —ও দাদু…ও পাঁউরুটিদাদু-উ-উ…ডাকতে ডাকতে ছুট দিতাম। রুটি, মাঝে মাঝে ক্রিম রোল বা ক্রিম বন কিনতে কিনতে নানা প্রশ্ন – তোমার গাড়িতে প্যাডেল নেই কেন? তোমার বাড়ি কোথায়? কতদূর হেঁটে যাবে তুমি এখন… গতকাল আসনি কেন? – উনি বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে হেসে হেসে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। সত্যি বলতে কি, এই পাঁউরুটিদাদুর জন্য আমার তখনো খুব কষ্ট হত, এখনও হয়। কেন কষ্ট হত ঠিক জানিনা, হয়ত অত বয়স্ক মানুষটাকে পরিশ্রম করতে দেখে কষ্ট হত। বর্ষাকালে বৃষ্টির থেকে বাঁচতে উনি মাথায় চাপাতেন একটা প্লাস্টীকের শীটের খানিকটা জোড়াতালি মারা জিনিস। সেটা কোনমতে মাথাটা বাঁচাতো। শীতের একটা ছেঁড়া মিলিটারি কোট আর মাফলার। কিছুদিন আগে জানতে পারলাম উনি আর নেই। এখন ওনার ছেলে পাঁউরুটি ফেরি করে।

তারপর কবে যেন বড় হয়ে গেলাম, ফেরিওয়ালাদের মুখগুলি পালটে গেল, কেউ কেউ হারিয়ে গেল। আমিও পড়াশোনা এবং কর্মসূত্রে মহানগরবাসী হয়ে এইসব মানুষগুলিকে প্রায় ভুলেই গেছিলাম। কলেজে পড়াকালীন উত্তর কলকাতার এক হোস্টেলে থাকতাম । তখন একজন ফেরিওয়ালাকে অবশ্য মাঝে মাঝেই দেখতাম, সে একটা বাক্স গলায় ঝুলিয়ে ইঁদুর-আরশোলা-উকুন মারার ওষুধ বিক্রি করত। একবার আমাদের ঘরের প্রায় সব কেশবতী কন্যাদের মাথায় ঐ শেষেরটির ভয়ানক প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। তখন কিন্তু ওই ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনা পাতলা কাগজে মোড়া সেই গুঁড়ো ওষুধ অমোঘ কাজ দিয়েছিল।
ইদানীং কয়েকবছর যাবত বর্ধিত কলকাতার একটি অংশে বসবাস করছি। এই অঞ্চলটি ক্রমঃবর্ধমান। এখনও আধা মফস্বলী, এবং খানিকটা গ্রাম্যভাব এখনও ছড়িয়ে আছে বহুতলগুলির আনাচে কানাচে। তাই সাপ্তাহিক পত্রিকা, খবরের কাগজের উইকএন্ড কলাম বা এফ এম চ্যানেলের অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝেই যতই দুঃখ করা হোক না কেন যে কলকাতা থেকে ফেরিওয়ালারা হারিয়ে গেছে – সেই কথাটিকে সম্পূর্ন ভুল প্রমান করে আমাদের পাড়ায় ফেরিওয়ালাদের অবাধ আনাগোনা।

আমার ঘুম রোজ ভাঙ্গে “ফুলঝাড়ূ-উ-উ-উ…ঝুলঝাড়ু-উ-উ-উ” শুনে। তারপর প্রায় নিয়মিতই আসে ‘কাগজ বিক্রি’ , ‘মাআআআছ- চিংড়ী-পারশে-তোপসে’, ‘চাবিওয়ালা’, ‘শিল কাটাও’ ,’নারকেল-পেয়ারা-ডাব’, ‘ সব্জী’, ‘সোফা-গদি সারাই’, ‘পুরোনো-লোহা-কম্পিউটার-হিটার-গীজার-বিক্রি’, ‘প্লাস্টীকের বালতি-গামলা’…। একেকজনের হাঁক পাড়ার স্টাইল একেক রকম, গলার আওয়াজ একেকরকম, মাঝে মাঝে তো তাদের উচ্চারন বোঝাই দায়!! শীতকালে আসে ‘মশারি-লেপ-কম্বলের ওয়াড়’, গরমের দুপুরে আর সন্ধ্যেবেলায় ‘কোয়ালিটি আইস্ক্রিম’…এমনকি আমার সেই ছোটবেলার টং টং আওয়াজ করা দোসাওয়ালাও চেহারা পালটে চলে আসে মাঝে মাঝে। এমনকি ভ্যানে নানারকমের পসরা নিয়ে ‘হরেক মাল দশ টাকা’ ও আসে।

ফেরিওয়ালা, বাসের কন্ডাকটার, ড্রাইভার- এইসব পেশার সম্পর্কে সবথেকে বেশি কৌতুহল ছোটদের, এবং ছোটবেলায় আমরা সবাই কোন না কোন ভাবে মনে হয়ে এইসব মানুষদের কে জীবনের আইডল বানিয়েছি। আমার উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের একটি ছোট্ট ছেলে গতবছর অবধি তার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হেঁকে যেত- “যাদবপুর-গড়িয়াহাট-উঠুন-উঠুন-নামুন-নামুন-আস্তে লেডিস…” এইবছর সে কয়েকটি বাক্স একের পর এক জুটিয়ে আইস্ক্রিমের গাড়ী বানিয়ে আইস্ক্রিম বিক্রি করছে। এই প্রসঙ্গেই আরেকটা ছোটবেলার ঘটনা বলে শেষ করব। আমাদের পাড়ায় সমবয়সি মেয়েদের মধ্যে ছুটির দিনের সবথেকে জমজমাটি খেলা ছিল ‘রান্নাবাটী’ – অর্থাৎ খেলানার হাঁড়ী-কড়াই জুটিয়ে নিয়ে নিরন্তর রান্না-বান্না করে খাওয়া এবং খাওয়ানো এবং আবার রান্না করা। ধুলো-মাটি-গাছের-ফুল-পাতা যোগাড় করে তৈরি হত আমাদের ভাঁড়ার। এইরকমই এক শীতের ছুটিতে আমাদের পাড়াতুতো বুম্বাদা তার পৈতে উপলক্ষে উপহার পেল একটি সাইকেল। এক শীতের সকালে নতুন সাইকেল এ দুপাক ঘুরে এসে বুম্বাদা ঘোষণা করল সে হচ্ছে হাজরাকাকু, কারন তার সাইকেল আছে, এবং সে আমাদের মাছ বিক্রি করবে। নিজের সাজ সজ্জা সম্পূর্ণ করতে বুম্বাদা গলায় জড়ালো হাজরাকাকুর মত মাফলার, এবং আমাদের বাগানের গুলঞ্চগাছের ঝরে পড়া বড় বড় পাতাগুলিকে নিজের সাইকেলের ক্যারিয়ারে আটকে দিল – সেগুলি হয়ে গেল মাছ। মুশকিলটা হল তারপরে। যেহেতু বুম্বাদার প্রচুর ‘মাছ’, এবং কেনার লোক একমাত্র আমরাই, তাই সেইদিন সকালে আমাদের প্রতি দশ-পনেরো মিনিট অন্তর [মানে সাইকেলে পাড়ার এক চক্কর কাটা হলেই ]আমাদের ‘হাজরাকাকু’র কাছ থেকে ‘মাছ’ কিনতে হয়েছিল। অত মাছ নিয়ে আমরা কি করেছিলাম, সেটা অবশ্য এখন আর মনে নেই।