২০১০ সালের পুজো কেটে গেল। প্রথমেই জানাই কফিহাউসের সমস্ত আড্ডাবাজ্দের শুভ বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা। মা দুর্গা দোলায় এসে সারা পুজো বৃষ্টিতে সকলকে যথেষ্ট নাকাল করেছেন, ফিরে যাচ্ছেন হাতির পিঠে চেপে। ফল নাকি শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা। ফলন্তী বসুন্ধরার মত আপনাদের সবার জীবন ও হয়ে উঠুক সবুজ শ্যামল, এই কামনা করি।
এই শরতে আমার জীবনে এল এক বড় পরিবর্তন। আমি ছোট্টবেলা থেকে যে প্রান্তিক শিল্পনগরীতে বড় হয়েছি, খেলে বেড়িয়েছি, স্কুলে গেছি, সেই রূপনারায়ণপুর ছেড়ে আমার বাবা মা পুরোপুরিভাবে চলে এলেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কোদালিয়ায়, একটি নবগঠিত আবাসন প্রকল্পে। খোলা বাগান, রোদেভরা উঠোন, দখিন খোলা চাঁদ-সূ্য্যি ঢালা বারান্দার জায়গা নিল দুই কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট। এই সিদ্ধান্ত না নিয়েও উপায় ছিল না। কলকাতা থেকে যাতায়াতে প্রায় সাত-আট ঘন্টা সময় লেগে যায়। আমি বা আমার ভাই কাজকর্মের চাপে বছরে বার দুয়েকের বেশি যেতে পারতাম না। যে কোন কারণবশতঃই হোক, ওদিকে চিকিতসা ব্যবস্থাও খুব একটা সুবিধাজনক হয়ে ওঠেনি। আমার বাবা মাও চাইছিলেন আমাদের কাছকাছি থাকতে। তাই সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পাট গুটিয়ে চলে আসা হল।
গত মাস দুয়েক খুব ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। তাই ইচ্ছা থাকলেও কফিহাউসে আলাদা করে ছোটবেলার পুজোর কথা লেখার সময় পেলাম না। শেষ অবধি দেবীপক্ষের প্রথম দিনে আমার বাবা মা বাইশ বছরের পুরোনো বাড়ি এবং প্রায় সাতচল্লিশ বছরের বাসভূমি ত্যাগ করলেন। আমার বাবা আর মা, দুজনেই শিক্ষকতা করতেন হিন্দুস্থান কেবল্স্ নামক টেলিফোন তার তৈরির কারখানার স্কুলে। ছোটবেলায় থেকেছি কোম্পানির ছোট্ট কোয়ার্টারে, যা আজকালকার ফ্ল্যাটের শামিল; ১৯৮৮ সালে আমাদের বাড়ি তৈরি হয়, হিন্দুস্থান কেব্ল্স্ এর পার্শ্ববর্তী এক অঞ্চলে, যার পোষাকী নাম কল্যাণগ্রাম। এই অঞ্চলে বাড়ি করার বা জমি কেনার সুযোগ ছিল একমাত্র ওপার বাংলার ছিন্নমূলদের, যারা রূপনারায়ণপুর এবং চিত্তরঞ্জন, এই দুটি শিল্পনগরীর কারখানায় কাজ করতেন, অথবা ওই অঞ্চলে ব্যবসা করতেন । বাগান ঘেরা দু কামরার কোয়ার্টার থেকে চলে এলাম অপেক্ষাকৃত বড় একটা বাড়িতে; সামনে ফুল বাগান, পেছনে ফল-সব্জির বাগান, কুয়ো, উঠোন। মায়ের জন্য আলাদা পুজোর ঘর, ঠাকুমার জন্য আলাদা নিরামিষ রান্নাঘর। কিন্তু একটা জিনিষ ছিল না। বিদ্যুত। বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, পাশের শিল্পনগরীতে আলো ঝলমল করলেও কল্যাণগ্রাম ছিল অন্ধকারে। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল অবধি আমাদের বাড়িতে বিদ্যুত ছিল না। আমার আর ভাইয়ের তখন ভরপুর স্কুল জীবন; কিন্তু হটাত করে বিদ্যুত ব্যবস্থা ছেড়ে লন্ঠন ব্যবস্থায় গিয়েও আমরা খুব একটা দুঃখিত হইনি। অভ্যাস হয়ে গেছিল। ঐ অন্ধকারে থাকতে থাকতে ভালবাসতে শিখেছিলাম চাঁদকে; অমাবস্যা পেরোলে অপেক্ষা করে থাকতাম পূর্ণিমার জন্য; পূর্ণিমার রাতে দুধ সাদা জ্যোৎস্নার আলোয় নেয়ে মোম সাদা হয়ে থাকত মাঠ ঘাট, উঁচু-নীচু পাথুরে জমি, ছায়া ছায়া দেখা যেত বাড়িঘর, গাছপালা...রাস্তা দিয়ে হতাৎ ক্রিং ক্রিং ঘন্টি বাজিয়ে চলে যেত দোকান বন্ধ করা সাইকেল, আমরা জৈষ্ঠের রাতে চাঁদের আলোয় বালিশ ঠাণ্ডা হতে দিতাম...
কালীপুজোর রাতে কল্যাণগ্রাম হয়ে যেত রাজকাহিনীর হাম্বিরের দেশ। মাল্ভূমি অঞ্চল বলে দক্ষিণবঙ্গের মত সমতল হয়, পুরো অঞ্চলটাই ছিল উঁচু নীচু জমি- এই রাস্তা উঠে যাচ্ছে, সাইকেল থেকে নেমে গিয়ে সাইকেল ঠেলতে হচ্ছে, আবার এই রাস্তা গড়গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে ঢালুর দিকে। ফলে বাড়িগুলিও ছিল বিভিন্ন উচ্চতায় অবস্থিত। তখন চারিদিকে আজকের মত এত নানারকমের বৈদ্যুতিক বাহারি বাতির চল ছিল না। মোমবাতি আর প্রদীপ, এই দুটিই ছিল আলোকসজ্জার প্রধান উপকরণ। আর কল্যাণগ্রামে তো বিদ্যুতই ছিল না, কাজেই বাহারি বাতির প্রশ্নই ওঠে না। সন্ধ্যাবেলা নানান উচ্চতায় জ্বলে উঠত ছোট্ট ছোট্ট প্রদীপ, তিরতির করে কাঁপত মোমের আলো। আমার মনে হত আমি রূপকথার দেশে চলে গেছি। বিদ্যুত আসার পর এই এক দৃশ্য দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম।
ওদিকে গ্রীষ্ম বড় কঠিন। চড়া রোদ্দুর, শুকনো লু বইতে থাকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে। কলকাতার মত ঘামে হয়রান হতে হয়না, কিন্তু ঝলসে যায় মুখ চোখ। রুক্ষ্ম, উষর অঞ্চলকে সবুজ করার জন্য একবার গাছ লাগানোর কথা ভাবা হয়। আমার বাবা আমাদের বাড়ির সামনে লাগিয়েছিলেন কৃষচূড়া, রাধাচূড়া আর অশথ্ব গাছ। সেই ছোট্ট চারাগুলি এখন বিশাল বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়ে ছায়া বিস্তার করে আছে রাস্তার অনেক অংশ জুড়ে। পথচলতি মানুষের দু-দন্ড শীতল বিশ্রামের ঠাঁই হয়েছে।
বর্ষা ছিল বড় আনন্দের। উঁচু নীচু লাল কাঁকুড়ে জমি বলে জল টেনেও যায় তাড়াতাড়ি, আর রাস্তায় জল জমেও না। শুধু মাঝে মাঝে এক- আধটা ভাঙ্গা চোরা জায়গা থাকলে সেখানে যদি জল জমে তো আমাদেরই মজা - আসার পথে একটু জুতো ভিজিয়ে নেওয়া গেল...আপনারা কেউ কোনদিন ফাঁকা মাঠের মধ্যে বৃষ্টির তাড়া খেয়েছেন? মানে আপনি ছুটছেন আগে আগে, কয়েক মিটার দূরে দূরে পেছনে ঝমঝমিয়ে এগিয়ে আসছে বৃষ্টি...জোর প্রতিযোগিতা চলছে...বৃষ্টি যেন ধরে না ফেলে, ভিজিয়ে না দেয়...ছুটতে ছুটতে গেট ঠেলে কামিনী-গন্ধরাজ-যুঁই-বেল-হাস্নুহানার গন্ধ মাখানো পথ ধরে প্রায় ঢুকেই পড়েছি বাড়িতে, এমন সময়ে কিনা লাস্ট ল্যাপে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল দুষ্টু মেঘ...
শরতে বাগান জুড়ে ফুটে থাকত থোকা থোকা গোলাপি স্থলপদ্ম, বেগুনী দোপাটি, সাদা টগর আর হলুদ কাঞ্চন, নরম সাদা-কমলা শিউলিতে ছেয়ে থাকত গাছতলা। সেই শিউলি পড়তেই থাকত শরত ছাড়িয়ে হেমন্তের শিশিরঘেরা ভোরে।
আমার বাবা খুব বাগান করতে ভালবাসেন। তাই শীতকালে আমাদের বাগান আলো করে থাকত রং-বেরঙের ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, বৈজয়ন্ত আর অবশ্যই গাঁদা। একবার সরস্বতী পুজোর ভোরে সমস্ত গাঁদাগাছ থেকে সব ফুল তুলে নিয়ে চলে গেছিল দুষ্টু ছেলের দল। তারপর থেকে বড় বড় গাঁদাগাছ কেবলমাত্র টবে লাগানো হত । পেছন বাগানে বাবা লাগাতেন মটরশাক, গাজর, টোমেটো, বেগুনের গাছ। মাঘের শীতে সকালের রোদ্দুর পিঠে দিয়ে ছোট্ট মটরক্ষেতের আরো ছোট্ট মটর গাছে ফলে থাকা মিষ্টি কচি মটর তুলে তুলে খাওয়ার সে আনন্দ ভোলার নয়।
কুয়োর থেকে জল তুলে স্নান করা, ধোয়া মশলা থেকে হঠাত করে কুয়োর পারে গজিয়ে ওঠা কালোজিরে বা সর্ষের গাছ, শীতকালে সেই সর্ষেফুলের বড়া খাওয়া, পেঁপে, পেয়ারা, কলা, আম বাগানের গাছ থেকে পাকা পেড়ে খাওয়া, এইসব নিত্যনতুন আনন্দের মধ্যে গ্রীষ্মকালের প্রচন্ড গরম, বা বিদ্যুত না থাকা, এইসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। আমার মনে আছে, প্রথম কলকাতায় কলেজে পড়তে এসে, আমি হাওড়া স্টেশনে বা রাস্তায় পেয়ারা এবং পেঁপে বিক্রি হতে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম; আমার ধারণাই ছিল না, পেয়ারা, গন্ধলেবু বা সজনে ফুল বাজারে বিক্রি হতে পারে - ওগুলি বাগানে হয় এবং বাগান থেকেই তুলে খেতে হয়, এটাই আমার কাছে স্বাভাবিক ছিল।
লিখতে থাকলে লিখেই যাব, কথা ফুরোবে না। আজকের মত এইটুকু থাক। আপাততঃ আমরা পুরোপুরিভাবে মহানগরীর কাছাকাছি চলে এলাম। আলোয়-কালোয় মেশা ছোটবেলার স্মৃতিগুলি নাহয় মাঝে মাঝে নাড়াচাড়া করব...কফিহাউসে, বা অন্য কোথাও, তারপর আবার তুলোয় মুড়ে ন্যাপথলিন দিয়ে তুলে রাখব ঠাকুমার বিয়েতে পাওয়া লোহার সিন্দুকে। রূপনারায়ণপুর-কল্যানগ্রাম-হিন্দুস্থান কেব্ল্স্-চিত্তরঞ্জন , আমাদের ছোটবেলার বিচরণভূমি শিল্পনগরী এবং আশেপাশের শহরতলী গুলিকে ছেড়ে চলে আসার দুঃখ খুব বেশি করে অনুভব করছি এমনটা অবশ্য নয়। গত দেড় দশক ধরে কলকাতায় থেকে থেকে আমি এখন কালি-ধুলো মাখা কলকাতারই লোক হয়ে গেছি। কিন্তু মাঝে মাঝে ঠিকই মনে পড়বে উঁচু নীচু রাস্তা, গাছপালা, বাড়ি, পড়শী, জলের ড্যাম আর সূর্যাস্তের আলোয় সিহ্ল্যুয়েট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাঙ্গোই পাহাড়কে।
বিজয়ার চিঠি
- Details