আমাদের ছোটদাদুর, মানে বাবার ছোটকাকার একটা জুতোর দোকান ছিল। চন্দননগর বাবুরবাজার মোড়ের একেবারে ওপরে- 'তারা মা শু স্টোর্স'। দাদু দিনে অফিস করতেন, আর সন্ধ্যাবেলায় খুলতেন জুতোর দোকান। আর ছুটির দিনে দুইবেলাই খুলত সেই দোকান। এটা অবশ্য আমি আন্দাজে লিখলাম, কারণ আমরা তো ছুটিতেই বেড়াতে যেতাম, তখন তো দুইবেলাই দোকান খোলা থাকতে দেখেছি। আর দোকানে কোনো কর্মচারী ছিল না বলেই আমার মনে পড়ে, তাই কাজের দিনে বোধহয় সকালে দোকান বন্ধই থাকত । সেই দোকানের ক্যালেন্ডারে অবধারিত ভাবেই তারা মায়ের ছবি থাকত। 'তারা মা শু স্টোর্স'-এর ঠিক পেছনেই হত বাবুরবাজারের ঠাকুরপুজোর বিরাট মন্ডপ। তাই পুজোর ক'দিন, ওদিকে গেলে একবার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আসা, ভেতরে বসে দু-দন্ড জিরিয়ে নেওয়ার অভ্যাস ছিল আমাদের। আর পুজোর সময়ের নতুন জুতো আমরা পেতাম ছোটদাদুর থেকে। এই অভ্যাসটা মোটামুটি ক্লাস ফাইভ অবধি অব্যাহত ছিল।
সেই ক্লাস ওয়ান-টু-থ্রিতে, পুজোর নতুন জুতো মানে ছিল কালো স্কুল শুজ্ , সঙ্গে সাদা মোজা। তাও আমার জন্য নির্দিষ্ট ছিল সামনের দিকটা গোলাকার কালো শুজ্ , বন্ধুদের মত সামনের দিকটা সূঁচালো, খানিক ব্যালেরিনার মত দেখতে শুজ্ নয়। অমন জুতো পরলে নাকি পায়ের স্বাভাবিক গঠন বদলে যেতে পারে - এমন বক্তব্য ছিল বাবার। তো সেই গোলমুখো আনফ্যাশনেব্ল্ কালো জুতোই নেওয়া হত। সারাবছরে ব্যবহার করার জন্য আলাদা শখের চটি কিছু ছিল বলে মনে পড়ে না। খেলতে বেরোনোর জন্য ছিল আলাদা চটি, স্কুলের পিটিক্লাসের জন্য সাদা 'কেডস' অবশ্যই ছিল, কিন্তু বাকি সময় --- বিয়েবাড়ি হোক বা বাজার কিংবা মেলা বা এমনি কারোর বাড়ি বেড়াতে যাওয়া --- 'ভালো' জুতো বলতে ওই কালো জুতো সাদা মোজাই ছিল বাঁধা।
ক্লাস টু-তে যখন আমি, ছোটপিসির বিয়ে হল। পিসির বিয়ের চটি দেখলাম- কী সুন্দর লাল টুকটুকে সুয়েড ফিনিশের চটি, হাত বোলালে আরাম লাগছে। ওপরের স্ট্র্যাপে জরির ফিতে বসানো। এমন সুন্দর দেখতে চটি আমি তার আগে কোনোদিন দেখিনি। কয়েক মাস পরে পুজোতে চন্দননগরে গিয়ে, দাদুর দোকানে দেখি আমার মাপের ঠিক ওইরকম চটি সাজিয়ে রাখা আছে। বাবাকে ওটা নিতে বলেছিলাম কিনা সেটা মনে নেই, কিন্তু বলে থাকলেও সেই আর্জি খারিজ হয়ে গেছিল এবং কালো জুতোর বাক্স নিয়ে ফিরতে হয়েছিল।
কিন্তু আমি যখন ক্লাস থ্রী বা ফোর, তখন বোধহয় বাড়ির কেউ দয়াপরবশ হয়ে বাবাকে বলেছিলেন পুজোর সময়ে জুতো না নিয়ে সুন্দর দেখতে একটা চটি নিতে - একটু একটু বড় হয়ে গেছি তখন, জুতো কিছুতেই নেব না বলে আবদার ধরেছিলাম। তাই ছোটদাদুর দোকান থেকে পছন্দ করে নিয়ে এলাম আমার সেই প্রথম শৌখিন চটি। একটা লালচে মেরুণ রঙের চটির ওপর কী সুন্দর হলুদ-খয়েরি রং দিয়ে আল্পনার মত নকশা এমবস করা ছিল। সেই চটি পরে, সঙ্গে পায়ের আঙুলে ম্যাচিং নেলপলিশ লাগিয়ে এক লাফে খানিক বড় হয়ে গেলাম।
পরের বছর আমি বিরাট এক ঝুঁকির কাজ করলাম। ততদিনে এক বছর বয়স বেড়ে গেছে। চন্দননগর পৌঁছে কিছু বাহানা করেছিলাম, বা সুযোগ এসেছিল, তাই বাবার বদলে কাকুমণির সঙ্গে ছোটদাদুর কাছে জুতো অভিযানে চললাম। বাবা সেদিন কেন সঙ্গে যাননি মনে নেই আর। সম্ভবতঃ সেদিনই পৌঁছেছি, তাই বাবা সারাদিনের ধকলের পর আর বেরোতে চান নি। দোকানে যেতেই ছোটদাদু খুব আদরে বেশ কয়েকটা চটি বের করে দেখালেন। কিন্তু আমার চোখ ততক্ষণে চলে গেছে দেওয়ালের হুকে ঝুলিয়ে রাখা একজোড়া স্ট্র্যাপযুক্ত হিলতোলা চটির দিকে, দুধছাড়া কফির মত রং তাদের। অনেক অনেক বছর পরে,কলকাতার বাটার শো রুমে ঢুকে জেনেছিলাম অমনধারার হিলতোলা স্ট্র্যাপওয়ালা চটিকে বাটাতে 'মারি ক্লেয়ার' বলে। আমি ওই চটিজোড়া নেওয়ার দাবী জানালাম। ছোটদাদু আর কাকুমণি দুজনেই হাঁ। কাকুমণি আমাকে বলেই ফেললেন - এই জন্যই তুই আমার সঙ্গে এলি?... বাবা এটা দেখলে কী হবে জানিস তো?... কিন্তু ভবি সেদিন ভোলেনি। আমি সেই চটিটাই নিয়েছিলাম দাদুর থেকে। শুধু নিইনি, নতুন হিলতোলা চটিটা পরে আর পুরনো চটিজোড়া নতুন জুতোর বাক্সে পুরে বাড়ি ফিরেছিলাম। আমি জানতাম, রাস্তায় পরে আসা চটি বাবা কিছুতেই আর ফেরত দিতে পারবেন না। দোকান থেকে বাড়ি, মিনিট পাঁচ সাতেকের হাঁটাপথ। মনের মধ্যে ভয়ে গুরুগুরু হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু এটাও জানতাম এখানে আমাকে বাবার জোর পিটুনি থেকে রক্ষা করার মানুষের সংখ্যা অনেক। টিমটিমে স্ট্রীটল্যাম্পের আলোয় আমার হাত ধরে ফিরতে ফিরতে কাকুমণি বলেছিলেন- তোর তো দেখছি খুব বুদ্ধি!
বাড়ি আসার পরে, সেই চটিজোড়া দেখে বাবা বেজায় রেগে গেছিলেন কিনা সে আর মনে নেই, কিন্তু বাকি সবাই খুব হেসে আমার বুদ্ধির তারিফ করেছিলেন বলে আমাকে আর সেবার বেশি বকুনি বা কানমলা খেতে হয়নি। পুজোর পরে বাড়ি ফিরে বন্ধুদের সেই চটিজোড়া দেখিয়ে বেশ কয়েক মাস খুব অহংকার অনুভব করেছিলাম, বলাই বাহুল্য।
কিন্তু ওই অবধিই... তার পর থেকে বাবার সঙ্গে চটি বা জুতো নিয়ে যাওয়া মানেই আবার ঘুরে ফিরে ফ্ল্যাট কিংবা খুব কম হিলের জুতোই নেওয়া হত। কলেজে পড়ার সময়ে অবশ্য সেই শাসন আর চলেনি। তবে ভাগ্যের এমনই পরিহাস, হিল তোলা শৌখিন চটির সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচে যেতে বাধ্য হয়েছে বহুদিন আগে। এখন জুতোর দোকানে সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে 'ওয়েজেস', 'পিপ টোজ' ইত্যাদি দেখে তারপরে ভেতরে ঢুকে বলি - ওই নরমসরম অর্থোপেডিক চটি দিন তো! সে-ও পুজোর সময়ে নিয়ম মেনে নয়। যখন যেমন দরকার পড়ে, তখন।
ছোটদাদুর কাছ থেকে শেষবার চটি নিয়ে এসেছিলাম তাও আজ বছর কুড়ির বেশি হয়ে গেছে। তখন পড়াশোনার পাট চুকে গেছে, চাকরি করি। দক্ষিণ কলকাতার এক নামী বিপণী থেকে দাম দিয়ে একজোড়া শৌখিন চটি--- সেটাও আবার সেই বেল্ট দেওয়া --- কিনেছি এবং পরে চন্দননগর যাচ্ছি। মাঝপথে সেই কায়দার চটির ওপরের অংশ নীচের সোলের থেকে পুরো খুলে চলে এল। দুটো অংশ শুধুই আঠার ভরসায় জুড়ে ছিল, সেলাই-এর ছিটেফোঁটা ছিলনা, সেটা ওপরের চাকচিক্য দেখে বুঝিনি। আর যাঁরা জুতো বানিয়েছিলেন, তাঁদের কষ্টকল্পনাতেও বোধহয় ছিল না যে আমার মত ওজনদার কোনোও মানবী ওই চটি পরে হাওড়া স্টেশনে লোকাল ধরতে দৌড়াবে! কোনোমতে সেই ছেঁড়া চটি পায়ে স্টেশনে নেমে রিকশা ধরে রাঙাকাকুর বাড়ি পৌঁছলাম। বিকেলে রাঙামার চটি পরে সোজা দাদুর দোকান - ও ছোটদাদু, চটি দাও শিগগির একটা! --- ক্লাস ফাইভের পরে সেই আমার আবার চটি নিতে যাওয়া দাদুর কাছে। সেবারে একটা নয়, দুইজোড়া চটি নিয়ে এসেছিলাম দাদুর থেকে।
এর কিছুদিন পরেই বোধহয় 'তারা মা শ্যু স্টোর্স' বন্ধ হয়ে যায়। এখন ওখানে অন্য দোকান --- ঠিক কীসের জানিও না । কিন্তু কালে কস্মিনে ওই মোড়ে গেলে ওই বিশেষ দোকানঘরটাকে আমি মনে মনে 'ছোটদাদুর দোকান' বলেই চিহ্নিত করি। যেকোনো কারণেই হোক, আমি দোকানটাকে যখন দেখি, তখন সেটা বন্ধ থাকে। তাতে আমার কেমন এক নিশ্চিন্ততা বোধ জাগে। মনে মনে জানি, ওই বন্ধ কাঠের পাল্লার ফাঁক ফোকরে গুঁজে রাখা আছে আশ্বিনের আলোমাখা আমার বাল্যের অনেক ছবি।