আমার বেড়ে ওঠার শিল্পশহর হিন্দুস্থান কেবল্‌স্‌-এ, আমাদের দোতলা , এবং পরে কিছু তিনতলা কোয়ার্টারের একতলার বাসিন্দাদের মধ্যে বেশিরভাগই কোয়ার্টারের সামনে বাগান করতেন। খুব শৌখিন মরসুমি ফুল থেকে শুরু করে একেবারেই ন্যাড়া, মূলতঃ জামাকাপড় শুকাতে দেওয়া, সাইকেল/ গাড়ি রাখার জন্যই ঘিরে রাখা- এমন নানা ধরনের বাগান ছিল। . একটি একতলা কোয়ার্টারের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে আমাদের ও একখানি নানারকমের গাছপালা ভরা বাগান ছিল। আর আমাদের ঠিক মুখোমুখি দরজার মামা-মামীদের ও একখানা বাগান ছিল। মামা-মামী মানে শ্রী চিত্তরঞ্জন মুখার্জি আর শ্রীমতী সর্বানী মুখার্জি। চিত্তমামা বাবার সহকর্মী, আমার মায়ের চাকরি-সম্পর্ক্তুতো দাদা, তাই আমাদের মামা। মায়ের পিতৃকুলের পদবী মুখোপাধ্যায়, আর দুইজনে কাছাকাছি সময়ে নাকি হিন্দুস্থান কেবল্‌স্‌ এর স্কুলে কাজে যোগ দিয়েছিলেন, তাই সেসময় আশেপাশের লোকজন ফর্সা ফর্সা চেহারার চিত্তরঞ্জন মুখার্জি স্যার আর চন্দনা মুখার্জি দিদিমণিকে নাকি ভাই-বোন ঠাউরেছিলেন-এমন কথা মায়ের কাছে শোনা। সর্বানী মামী আমাদের কোয়ার্টারের পাশের বড় রাস্তার উল্টোদিকে প্রাইমারি স্কুলের দিদিমণি ছিলেন। আমাদের মায়ের স্কুল ছিল,সকালে,বাবা, মামা আর মামীর স্কুল দুপুরে। তাই আমাদের স্কুলে ছুটি-টুটি থাকলেও, পাহারাদারের অভাব ছিল না।
হেজগাছ আর পুটুস গাছ জড়িয়ে-মড়িয়ে তৈরি ছিল আমাদের দুটো বাগানের বেড়া। তারমধ্যে আমাদের ফুল-ফল-পাতাবাহারে ভরা প্রায় ছায়া ঢাকা বাগান যদি 'বাগান'-এর প্রমিত উদাহরণ হয়, তাহলে মামীদের রোদ ঝলমল বাগান আদতে মরুভূমি। আর মামীদের বাগান যদি বাগান হয়, তাহলে আমাদের বাগান হল গিয়ে আমাজনের জঙ্গল। মামীদের বাগানে ছিল, গোটা দুইতিনেক নয়নতারা ফুলের গাছ, এক-দুটো তুলসি, একটা বিরাট শিউলি গাছ, বেশ কিছু অতসী ফুলের গাছ আর একটা নারকেলি কুলের গাছ। শীতে ফুল দিত গোটা দুয়েক রক্তগাঁদা আর তারাগাঁদা গাছ। আর ছিল প্রচুর প্রচুর রোদ। রাস্তার একেবারে পাশে এবং দক্ষিণ দিক ঘেঁষা বলে , মামীদের বাগানে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোদ ঝলমল করত। আমাদে উত্তর ঘেঁষা বাগানে বারোটা বাজার আগে পরে ছায়া ছায়া হয়ে যেত। গ্রীষ্মের নিঝুম দুপুরে সেখানে কুবো পাখিরা লাল লাল চোখ ঘুরিয়ে গম্ভীর গলায় কুব-কুব-কুব ডেকে গিরগিটি ধরত। কিন্তু শীতে এই ঠাণ্ডা বাগানের কোনোও মর্যাদা ছিল না। পুরো শীতকাল, ছুটির সুযোগ পেলেই, বিশেষত দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পরে মোড়া নিয়ে মামীর বাগানে রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকাটা আমাদের সাদামাটা -রুটিনে বাঁধা জীবনে একটা আলাদ প্রাপ্তি ছিল। মামী আর মা.উল-কাঁটা নিয়ে নতুন সোয়েটার বুনছেন, বাবা আর মামা পেপার পড়ছেন, বা কিছু আলোচনা করছেন, ভাই বই পড়ছে বা মোড়ায় বসে বসে আসলে স্টার ট্রেকের ক্যাপ্টেন স্পক হয়ে মনে মনে অভিযানে চলেছে, আর আমি হয় আনমনে কমলালেবু খেতে খেতে কোনোও পুজোবার্ষিকী পড়ছি কিংবা মায়ের থেকে উল আর কাঁটা ধার করে পুতুলের মাফলার বুনতে গিয়ে হিসেবের বাইরে ঘর বাড়িয়ে ফেলছি কিংবা কমিয়ে ফেলছি ----চোখ বুজলে এমন কিছু ছবি ---- না ,মোটেও সিপিয়া টোনে নয়, বরং এই যেন গতকালই প্রিন্ট হয়ে এসেছে---এমন পরিষ্কার ঝলমল করে। আমাদের থেকে বেশ খানিকটা বড় বাবুন দা, মামা-মামীর ছেলেও থাকত মাঝে মাঝে, তার স্কুলে ছুটি থাকলে বা পড়াশোনার চাপ না থাকলে। কোনোও ছুটিতে মামীদের বা আমাদের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে, তাঁরাও সবাই দুপুরের রোদে মোড়া পেতে সেই রোদেলা আড্ডায় শামিল হতেন।

মামীদের বাগানের শিউলি গাছটাকে নিয়ে আলাদা একটা ছোট রচনা লেখা হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তাকে নিয়ে বিস্তার ফাল্গুনে নয়, আশ্বিনে করা যাবে। তবে অতসী গাছেদের কথা বলতেই হয়। মামীদের দক্ষিণের জানালার নীচে গোটা তিন চারেক অতসী গাছ ছিল। খানিকটা সীমের ফুলের মত দেখতে উজ্জ্বল লেবু হলুদ রঙের ফুল. ফুটত। তারপরে ফল হত। সেই ফল শুকিয়ে কালচে শক্তহয়ে গেলে, গাছ ধরে ঝাঁকালে ঝুমঝুম করে শব্দ হত। এই ফুল ফোটা থেকে ফল হওয়ার সময়কাল আমার এখন আর মনে নেই। ফুল সম্ভবতঃ শীতের শুরুতেই ফুটত, আর ফল শীতের শেষে শুকিয়ে আসত। নইলে আর অমন ঝুমঝুম আওয়াজ পরীক্ষা করে দেখতাম কীভাবে, যে গাছ-ফুল-ফল দেখে এবং আওয়াজ শুনে 'ঝুমঝুমি ভূতের রহস্য' নাম দিয়ে আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ ভৌতিক-গোয়েন্দা-রহস্য গল্প লিখে ফেলেছিলাম! শেষ করার পরে নিজেই বুঝেছিলাম লেখাটা বেজায় খাজা হয়েছে, তাই কাউকেই দেখাইনি, কেউ জানেও না, আমি নিজেই ভুলে গেছি কোন ক্লাসে ছিলাম তখন।.
মামীদের বাগানের বেড়া শেষ হত কোয়ার্টারের দক্ষিণ দেওয়ালের গা ঘেঁষে। আমাদের বাগানের মত আরও বেড় দিয়ে পশ্চিমে ঘুরে যেত না। বাগানের সেই শেষ প্রান্তে ছিল একটা নারকেলি কুলের গাছ। এখন যেমন বাজারে পাওয়া যায়, ডাবল এক্স এল আকারের কুল, তেমন নয়। সঠিক মাপমত নারকেলি কুলে গাছটা ভরে থাকত। সেই কুল বাগানের ভেতরে এবং বাইরে ছড়িয়ে পড়ে থাকত। পাড়ার বাচ্চারা তুলে নিয়ে খেত, তবে পাশের স্কুলের বাচ্চারা সেরকম ভাবে আসত না , বোধহয় মামী তাদের দিদিমণি বলেই। তারপরে একদিন সেই একতলা বাংলা মাধ্যম স্কুলের পেছনে আলাদা করে তৈরি হল হিন্দি মাধ্যম প্রাইমারি স্কুল। সেখানকার দুষ্টু ছেলেপুলেরা মামীকে চেনে না, তাই স্কুল ছুটির পরে গাছে ঢিল মেরে কুল পাড়তে তাদের আলাদা সাহসের প্রয়োজন হল না। বাগানের ভেতরে থেকে একটু বড় আমি, আর মামী থাকলে মামী, আমার ঠাকুমা,সবাই তাদের বেজায় বকা দিতাম। কুল নেওয়ায় আমাদের আপত্তি ছিল না, আপত্তি ছিল উড়ে আসা ঢিল গায়ে মাথায় লেগে যাওয়ার ভয়ে।
এইসব দস্যি ছেলেপুলেদের নজরে ছিল আমাদের পেছন বাগান ও। আমাদের পেছনের বাগানে , সেই একইরকম বেড়ার গা ঘেঁষে, ছিল একটা টোপা কুলের গাছ। মোটামুটি আলাদা কোনোও যত্ন না পাওয়া সেই গাছটা প্রতিবছর গাছ ভরে ফল দিত আমাদের। সেই কুলের সন্ধানে আমাদের বাগানেও হামলা হত। পেছনের বাগানের বেড়ার ওপর দিয়ে, কুলের কাঁটার তোয়াক্কা না করে, এমন ঝাঁপাঝাঁপি করত ছেলেপুলেরা, যে মাঝে মাঝে বেড়া ভেঙেও ঢুকে পড়ত। সেই গাছের পাকা ফল পড়ে বাগানের মাটি দেখা যেত না। তার মধ্যে বেশ কিছু পোকায় খাওয়া, পাখিতে খাওয়া। সেই সমস্ত কুল তুলে, বেছে, শুকিয়ে আমার মা তৈরি করতেন গুড়ে জ্বাল দেওয়া কুলের আচার। শীতে তৈরি বোতল্ভরা সেই কুলের আচার গ্রীষ্মের শেষ পাতে শান্তির আমেজ এনে দিত।

কলকাতায় শীতকাল এলে, গড়িয়ার মোড়ে ফলওয়ালাদের সামনে ডালায় সাজানো ক্ষণিকের অতিথি টোপাকুলগুলোকে দেখলে আমার লোয়ার কেশিয়ার বাগানের টোপাকুল গাছটাকে মনে পড়ে। আর মায়ের তৈরি সেই কুলের আচারমনে পড়ে। অবিশ্বাস্য বড় হাইব্রিড নারকেলি কুল দেখলে মামীদের গাছটাকে মনে পড়ে। কমলালেবু দেখলে মামীদের বাগানের রোদ মনে পড়ে। হস্তশিল্পমেলায় গিয়ে বেতের মোড়ার দেখা পেলে, একবার দেখেই নিই, মোড়াটাকে আরও শক্তপোক্ত রাখার জন্য তলায় পুরনো সাইকেলের টায়ার কেটে বাফার বানিয়ে বিক্রি করছে নাকি? কেউ সেভাবে বিক্রি করেনা জানি, তবুও মোড়া ভাবলেই অমন টায়ারের জুতো পরা মোড়াদের কথাই মনে পড়ে। ফ্ল্যাটের ছাদের প্লাস্টিকের টুলে রোদে পিঠ দিয়ে বসে, নীল আকাশে আমাদের পাশের পাড়ার কোনোও এক বাড়ির পোষা একঝাঁক পায়রাদের ঘুরে ঘুরে ওড়া আন্‌মনে দেখতে দেখতে আমি সেইসব মোড়াবিক্রেতাদের দেখতে পাই, বাঁকের এদিক-ওদিকেগোটা দশেক মোড়া ঝুলিয়ে যাঁরা বাড়ি বাড়ি মোড়া বিক্রি করতে আসতেন। পুরনো মোড়া বেশি ব্যবহারে ভেঙে বা তুবড়ে গেলে তাঁদের থেকে নতুন মোড়া কেনা হত। সেইসব মোড়ার ওপরে ঢাকার জন্য আলাদা ছোট পাতলা কুশন তৈরি করিয়েছিলেন আমার মা। .। নানা রঙের ঢাকনা, ঘরের পর্দা -চাদরের সঙ্গে মিলিয়ে উষা সেলাই মেশিনে ধার মুড়ে সেলাই করা, তারপরে কোনোটাতে ফেব্রিক, কোনোটাতে অ্যাপ্লিক করে সেট তৈরি করে রাখতেন মা। বচ্ছরকার দিনে খাটের চাদর, সোফার কভার বদলানো হলে, মোড়ারাও পেত পরিষ্কার , নতুন জামা।

ছিলাম শীতকাল আর কুলের গল্পে, চলে গেলাম মোড়া আর মায়ের সেলাই-এর গল্পে...সেটা হয়ত হওয়ারই কথা। যত দিন যাচ্ছে, যত একদিন একদিন করে বড় আর বুড়ো হচ্ছি, তত বুঝতে পারছি, আমি আসলে মনে মনে সেই রুখু কাঁকড়মাটির দেশেই ফিরে যেতে চাই। কলকাতার মত মহানগরে আড়াই দশকের বেশি থাকা হয়ে গেলেও, আমি এখনোও বোধহয় কলকাতার হলাম না। কলকাতাও বোধ হয় আমার হল না। নাড়ীর টান রয়ে গেছে ওই ওখানেই।.ওই যেমন বলে সবাই, স্কুলের বন্ধুদের মত বন্ধু হয় না, তেমনি, বোধ হয়, শৈশব যেখানে কেটেছে, সে জায়গার সঙ্গে অন্য কোনোও জায়গার তুলনা হয়না। আর প্রবল দুর্ভাগ্য না হলে, শৈশব স্মৃতির পরতে পরতে মা জড়িয়ে থাকবেন, সে আর এমন কী কথা?

সেইসব শৈশব স্মৃতিকে জিইয়ে রাখার খাতিরে, মামীদের বাগানের রোদের খাতিরে, বেতের সেইসব মোড়াগুলোর খাতিরে, আমাদের সেই টোপাকুলের গাছটার খাতিরে, আমার স্কুল-দিদিমণি মায়ের স্কুলের পরিশ্রমের পরেও সংসারের ব্যয়ভার লাঘব করার জন্য করা দ্বিগুণ পরিশ্রমের খাতিরে, এইবছর অবশেষে বানিয়ে ফেলেছি এক বোতল টোপাকুলের আচার। আদতে তত্বটা হল, মা যদি পেরে থাকেন তাহলে আমিই বা কেন পারব না? অন্তত চেষ্টা তো করেই দেখা যায়। প্রতিবছরই তালে থাকি, কিন্তু কুল, গুড় এবং আচার বানানোর সুযোগ বা সময়,এক রেখায় পড়ে না বলে আর মহাসন্ধিক্ষণ হয় না। কিন্তু এবারে হয়েছে। মায়ের থেকে জেনে নিয়ে, ব্যাপারটায় মোটামুটি পাশ করে গেছি। তারপরে আমার এই 'নিজেই নিজের পরীক্ষা নাও' প্রোজেক্টের সাফল্য আনন্দিত হয়ে, পোস্ট লিখব বলে আমাদের বাগানের পেছনের সেই টোপাকুল গাছটার একটা ছবিও এঁকে ফেলেছি। বাস্তবের ধারেকাছেও নয় যদিও, আর দেখে ফুলের গাছ মনে হচ্ছে, তবে সেটাও ঠিকই- ওই গাছটাতে এক এক সময়ে এত কুল হত যে গাছটা সব কুল পেকে গেলে পুরোটাই অমন সবুজ মেশানো পোড়া ইঁট রঙের দেখাত, কালচে সবুজ পাতা আর ফলের তফাত করা যেত না।

সরস্বতীপুজোর আগে কুল খেলে মা সরস্বতী যে বেজায় পাপ-টাপ দিয়ে থাকেন, পরীক্ষায় ফেল ও হয়ে যেতে পারে- আমার সরল সোনালি বাল্যকালে এই কথাটা যে.খুবই বিশ্বাস করতাম সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। . এই জটিল মধ্যবয়সে এসে একাধিক সরল বিশ্বাসের সঙ্গে সেটিও ফিকে হতে হতে হারিয়ে গেছে বলাই বাহুল্য। তাই গত কয়েক বছর ধরে সুমো পালোয়ান মার্কা সবুজ 'নারকেলি' কুল পুজোর আগেই খেয়ে ফেলি। আর .সরস্বতীপুজোর দিনে ভুল করে একটা অক্ষর দেখে ফেললেও পড়াশোনায় গোল্লা সুনিশ্চিত, এমন ভাবনায় কলা-টলা তো অনেককাল আগেই দেখিয়েছি। তাই সরস্বতী পুজোর দিনে একখানা আস্ত পোস্ট ও লিখে ফেললাম - মিষ্টি কুলের আচারের স্মৃতি, আচারের মত স্মৃতি, স্মৃতির আচার নিয়ে।