বেশ কয়েক বছর আগে, বিরিয়ানি রান্না করার জন্য ভালো মশলার খোঁজ করতে করতে গিয়ে ঢুকেছিলাম হগ মার্কেটে - সেখানে নাকি পাকিস্থান থেকে আমদানি করা খুব ভালো সব মুঘলাই রান্নার মশলা পাওয়া যায়। জন্মে থেকেই রাষ্ট্রযন্ত্র এবং জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার দৌলতে জেনে আসছি পাকিস্থান আমাদের পরম শত্রু, এবং যে ধর্মাবলম্বীরা পাকিস্থানের সংখ্যাগুরু, আর এদেশে থেকেও (না কি) সর্বদা পাকিস্থানকে সর্ব বিষয়ে সমর্থন করে, তারা সব্বাই বেজায় খারাপ লোকজন ( কারণ তারা এটা-ওটা খায় যেটা নাকি খাওয়া উচিত না, এরকম -ওরকম পোষাক পরে যেগুলো পরা উচিত না, এটা ওটা করে যেগুলো করা উচিত না, আর তারা নাকি সব্বাই সবসময়ে কাশ্মীরকে ভারতের থেকে কেড়ে নেবে বলে কুমতলব আঁটছে ) । তাই বলে আমিশাষী ভারতীয়রা বিরিয়ানি-কাবাব-পরোটা-রেজালা ইত্যাদি খাবেনা পণ করেছে, এমন কথা কোনোদিন শুনিনি, এমন কথা তো কোনোদিনও মাথায় আসেনি, কেউ একুশে আইনও জারি করেনি, তাই তখন পাকিস্থানি মশলা খুঁজতে যাওয়াটাও দেশদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়তে পারে- এমন আজগুবি চিন্তা দুঃস্বপ্নেও আসেনি- কিন্তু আজকের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে এমন হুজুগ কোনো দেশপ্রেমী তুললে অবাক হব না।
সারি সারি ছোট বড় দোকানের মধ্যে , বিশেষ কিছু না ভেবে, যেটার সামনে থামলাম, সেটি একটি ছোট্ট খুপরি, বাজারের সব থেকে ছোট দোকানগুলির মধ্যে একটি। গাদাগুচ্ছের চেনা-অচেনা মশলার মাঝে বসে এক শীর্ণকায় মধ্যবয়সী মানুষ, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, চোখে চশমা, পরনে শার্ট ও লুঙ্গি, মুখে হিন্দি-বাংলা মেশানো বুলি এবং একগাল হাসি। এটা চাই, ওটা চাই ইত্যাদি কথা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই সামনের বয়াম খুলে বার করে দিলেন মুঠোভরা কাজু -কিশমিশ-বাদাম। এরকম আপ্যায়নে অভ্যস্ত নই, তাই একটু চমকেই গেছিলাম প্রথমে। বিক্রি করার দামি জিনিষ আমরা এত এত করে বিনামূল্যে খামোখা নিতে যাব কেন, জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন -" খাইয়ে দিদি, সব আল্লাহ,কে দেন হ্যায়... খরিদনা বেচনা তো চলতা রহেগা..." , না না বলতে বলতে শেষ নিতে বাধ্য হলাম।
সেই শুরু। কয়েকবারের যাতায়াতে মৃদুভাষী মুখতার আহমেদ আমার চাচা হয়ে গেলেন। ধেড়ে শহুরে মিনির রোগা-পাতলা দিশি কাবুলিওয়ালা। তিন চার মাস পরে পরে গেলে প্রথমেই হাতে আসবে আলাদা ঠোঙায় শুকনো ফল, সাথে আলুবোখরার টক মিষ্টি মুখশুদ্ধি। ওজন করে করে জিনিষ মাপার সাথে চলতে থাকে নানা রকমের গল্প। সামান্য ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের গন্ডীটা নিজে থেকেই মুছে গেল একদিন। আলাপ হয়ে গেল চাচার ছোট দুই ছেলের সাথে। হাসিখুশি, অতি ভদ্র এবং বিনয়ী- একজন একটি রেস্তোঁরাতে রান্না করে, অন্যজন ক্রিকেট শেখে কোনো এক পুরনো ক্রেতার উদ্যোগে। বছর দুয়েক পরে, দুর্গাপুজোর প্রায় সাথে সাথে যখন রমজান মাস এল, তখন মনে হল, চাচার পরিবারের জন্য ফল কিনে নিয়ে যাই। ইফতারে খাবেন সবাই মিলে। চাচা খুব খুশি হয়ে আমাকে বলেছিলেন, আমি নাকি খুব বড় পুণ্যের কাজ করেছি, ইফতারের জন্য ফল দিয়ে। আমি অবশ্য পুণ্যের কথা ভেবে ফল কিনিনি । আমার মনে হয়েছিল, আমাদের দুর্গাপুজোর সময়ে যেমন বাড়ির প্রিয়জনেদের জন্য কিছু একটু উপহার কিনি, সেরকমই ওঁদের জন্যেও নিয়ে যাই। ঘরের মানুষের মত আদর যত্ন করেন যে!
কিন্তু মাস দুয়েক আগে একটা অন্য ঘটনা ঘটল, এ বছরের রমজান মাসে। চাচার কাছে গিয়ে ফল দিয়ে, কাজু- পেস্তা ইত্যাদি খেতে খেতে কেনাকাটি করছি, টুকটাক নানা প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে, মাঝে হঠাৎই চাচা বললেন, "নিজাম মেঁ বিফ বন্ধ কর দিয়া দিদি...বহুত খারাব কিয়া...হমারে সাথে ইয়ে সব ঠিক নহি হো রহা হ্যায়...এক বঙ্গালি বাবু নয়া মালিক হ্যায়, উসনে বিফ বন্ধ কর দিয়া...বঙ্গালি লোগ বহুত খরাব কর রহা হ্যায় হমারে সাথ..."
খচ করে কথাটা কানে লাগল। বাদাম চিবানো থমকে গেল কয়েক মূহুর্তের জন্য। বঙ্গালি লোগ? তাদের মধ্যে তো আমিও পড়ি। বেশ বড় বয়স অবধি, না ভেবেচিন্তে এবং না বুঝে, ইসলামধর্মী পরিচিতদের সম্পর্কে কথাবার্তায় মাঝেমধ্যেই বলে ফেলতাম- " আমরা বাঙালি, ওরা মুসলমান”। এই কথাটা এখনও অনেককেই ব্যবহার করতে শুনি। এই আপাত সাধারণ বাক্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে যে সামাজিক ঐতিহাসিক যৌথ চেতনার বিবিধ স্তর, সেগুলিকে ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করার পর থেকে সচেতনভাবে এই বাক্য ব্যবহার করা বন্ধ করেছি। হঠাৎ চাচার কথায় বুঝতে পারলাম, "ওরা বাঙালি, আমরা মুসলমান”- এরকম একটা বাক্যও তাহলে ভেসে বেড়ায় আমাদের চেনা-অচেনা আকাশে-বাতাসে। কিন্তু কেন ?
মাথার ভেতর এক রাশ কথা ভীড় করে এল। হ্যাঁ, আমি নিজেও দেখেছি, নিজামের দেওয়ালে আটকানো নোটিস - 'নো বিফ'। বেশ কিছুদিন আগেই দেখেছি। একটু অবাক হলেও, মাথা ঘামাইনি। আমি বিফ খাইনা। কিন্তু আমার পাশে বসে কেউ খেলে আমার কোনো সমস্যা নেই। তাই নিজাম বা আমিনিয়া বা এরকম আরোও অন্যান্য জনপ্রিয় খাওয়ার জায়গাগুলোতে বিফ বিক্রি হয় কি না, সেটা কোনও দিন ভেবে দেখারও প্রয়োজন বোধ করিনি। নাহুম'স এ গিয়ে পেস্ট্রি কেনার সময়ে যখন জানতে চাইনা মালিক যীশুর উপাসনা করেন না কি একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী, প্যাটিতে কোশের নুন দিয়েছেন না কি সাধারণ নুন; বা ধাবায় গিয়ে পঞ্জাবী খাবার খাওয়ার সময়ে যখন জানতে চাইনা তাদের মালিক বা রাঁধুনি আদতে বিশুদ্ধ শিখ না তপশিলী শিখ, তাহলে নিজামেই বা ভাবতে যাব কেন?
চাচাকে প্রথমেই বলতে ইচ্ছা করল – চাচা, সব বঙ্গালি একরকম নয়। আমার কিন্তু আপনার বিফ খাওয়া নিয়ে কোনোও সমস্যা নেই। তারপরেই মনে হল, আমার সমস্যা নেই তো কী হয়েছে? আমি ঠিক পশ্চিমবঙ্গের কত শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করি? তারপরে মনে হল- চাচা 'বঙ্গালি' বলে বলছে্ন কেন? উনি কি আসলে বলতে চেয়েছেন 'হিন্দুরা' খারাপ ? সব বাঙালি কি হিন্দু? না সব হিন্দুরা বাঙালি? তাছাড়া চাচা তো নিজেও এই বঙ্গে থেকেই ব্যবসা করছেন। ওঁর মুখেই শুনেছি তিন পুরুষের পুরনো দোকান ওঁদের। এতদিনেও নিজেদের বাঙালি ভাবতে পারলেন না ? কেন? সেটা কি ওঁরা ভাবতে চাননি বলে, না কি কলকাতা শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি হিন্দু অধিবাসিরা ভাবতে দেন নি বলে?
মাথার ভেতরে একে অপরের সাথে যুদ্ধ করতে থাকা একগাদা প্রশ্নের সংঘাতে আমি থমকে গেলাম। চাচাকে কোনো উত্তর দেওয়া হল না। আমাদের কথাবার্তার স্বাভাবিক সুরটা কেটে গেছিল। হাতের মুঠোয় শেষ ক'টা বাদাম ধরে ফিরে এলাম। মনটা তেতো হয়ে রইল।
তারপর থেকে ভেবেই চলেছি। আমার খুবই সৌভাগ্য যে আমার ছোটবেলাটা কেটেছে বাংলা বিহার ( অধুনা ঝাড়খন্ড) সীমান্তের এক শিল্পনগরীতে। সেখানে আমরা সব ধর্মের, সব অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের সাথে বড় হয়েছি, স্কুলে গেছি। সেখানেও অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী মানুষ হিন্দুই ছিলেন। কিন্তু তার জন্য আমাদের মুসলমান, শিখ, বা খ্রিশ্চান বন্ধু থাকতে কোনোও অসুবিধা হয়নি। আর শিল্পনগরী বলেই, আমাদের আশেপাশে, মা-বাবাদের সহকর্মী এবং স্কুলের বন্ধুরা অনেকেই ছিল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ; বিভিন্ন আদিবাসী জনজাতির বন্ধুও অনেক ছিল। আমরা একই সঙ্গে বাংলা, হিন্দি আর ইংরেজিতে কথা বলতে ও বুঝতে পারতাম। ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিবারে অন্তত, জাতপাত বা কোন প্রদেশের মানুষ , তার বিচারে বন্ধুত্বে কোনোও বাধা হয়নি কোনো দিন। আমার বাবার পরিবারও স্বাধীনতার আগে আগে বাংলাদেশের নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে কলকাতা শহরের অনিশ্চয়তার মধ্যে এসে পড়তে বাধ্য হন, এবং পরবর্তী সত্তর বছর ধরে, আজ অবধি, আমরা আদতে ছিন্নমূলই রয়ে গেছি। কিন্তু খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে, আমাদের পরিবারের কাউকেই বলতে শুনিনি, "মুসলমানেরা খুব খারাপ, ওদের ছায়া মাড়াস না..." ইত্যাদি। মনে মনে কোনো দুঃসহ অভিজ্ঞতা প্রসূত সেইধরণের ভাবনা চিন্তা থেকে থাকলেও, আমার বা আমার ভাইয়ের মনে সেই রকম কোনো ভাবনার বীজ তাঁরা পুঁতে দেন নি।
তাই বলে কি সেখানেও সবাই একই রকম ভাবত? মোটেও না। আমার অনেক বন্ধুই ছিল , যারা বিহারি বা উত্তরপ্রদেশীয় বন্ধুদের 'খোট্টা' বলে সামনে বা পেছনে ডাকত। কিন্তু সেই তারাই আবার ছট পুজোর সময়ে বিহারি বন্ধুদের থেকে ঠেকুয়া আদায় করে খেত। ভাষার বা সংস্কৃতির রাজনীতি কোনোওদিন বন্ধুত্বের থেকে বড় হয়নি। বড় হয়নি ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দের থেকেও।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। যত দিন যাচ্ছে, তত মনে হচ্ছে আমার, এবং আমাদের, ভাবনা-চিন্তার পরিধিটা দায়িত্ব নিয়ে, জোর করে ছোট করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। 'আমরা আর ওরা'-র সামাজিক-সাংস্কৃতিক রাজনীতির জটিল আবর্তে ক্রমশঃ ডুবে যাচ্ছি আমরা। আর ভেসে থাকার চেষ্টা করে যেতে যেতে আবিষ্কার করছি, যে চিরকালের মতই, 'ওদের'কে , 'আমাদের' থেকে নিকৃষ্ট বা ভয়ঙ্কর ভাবার পেছনের প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি হল আমাদের সামগ্রিক অজ্ঞতা। এত কম জানি আমরা একে অপরকে, এত কম চিনি, এর কম জানতে বা চিনতে চাই, আর এত কম জায়গা দিই, বা দিতে চাই !
চাচাকে আমি কার তরফে, কী উত্তর দিতাম? একজন পশ্চিমবঙ্গবাসী, মধ্যবয়সী, শহুরে, প্রথাগতভাবে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, বাঙালি, হিন্দু মহিলা হিসাবে আমি আসলে মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে কতটা জানি? কী জানি? ভেবে দেখলাম, প্রায় কিছুই জানি না। প্রথমেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কতজন মুসলমান চরিত্রকে আর বাস্তবের মানুষকে আমি ছোটবেলা থেকে জেনে বা চিনে এসেছি? আলিবাবা এবং আলাদীনের পরেই মনে পড়ল আবদু্ল মাঝি, তারপরে গফুর জোলাকে। ( মহারানীর রাজত্বে হিন্দু জমিদারী, ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং জাতপাতের বেড়াজালে আটকে পড়া গরীব গফুর নিজের সন্তানসম গৃহপালিত ষাঁড়ের নাম আদর করে মহেশ রেখেছিল; আজকের দিনে হলে এরকম একখানা গল্প লেখার আগে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-ও চিন্তান্বিত হতেন, সন্দেহ নেই। ) তারপরে ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা একাধিক সম্রাট এবং নবাব। তারা কেউ কেউ খুবই ভালো, কেউ কেউ বেজায় খারাপ। পাশেপাশে এসে ভিড় জমালেন ছোটবেলার পাকিস্থানি এবং ভারতীয় ক্রিকেটের বেশ কিছু নক্ষত্র –তারপরেই চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীত জগতের মানুষেরা - ভিড় করে এল একাধিক প্রিয় মুখ। সাথে কয়েকজন লেখক, কয়েকজন শায়র, কয়েকজন চিত্রশিল্পী; কিন্তু এঁদের কাউকেই আমি সরাসরি চিনি না। চিনি এঁদের কাজের মাধ্যমে, আর পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার বা প্রতিবেদন পড়ে।
আর সত্যিকারের, সরাসরি, ক'জন ইসলাম ধর্মাবলম্বীকে চিনি আমি? একেবারে ছোটবেলায় আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন খোদাকাকু- ফতিমা কাকিমা। আমাদের বন্ধু রোজি আর বাচ্চুর বাবা-মা। রোজি ছিল আমাদের রান্নাবাটি খেলার নিত্যসঙ্গী। পুজোয় নতুন জামা পরত, দোলের দিন রং ও খেলেছে, যদ্দুর মনে পড়ছে। তবে আমি রোজিদের বাড়ি কোনোদিন বিস্কুটের বেশি কিছু খেয়েছি বলে মনে পড়ছে না। পাড়ায় আর কোনোও মুসলমান পরিবার ছিল না। পুরো স্কুল জীবনে জনা তিনেক মেয়েকে মনে পড়ল, যারা সহপাঠী ছিল। কলেজে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ ছিল না। যখন চাকরি করতে ঢুকলাম, তখন কিছুদিনের জন্য আমার সহকর্মী ছিলেন আর্ট কলেজ ফেরত আতাউরদা। ৯৯% পুরুষ ভর্তি কাজের জায়গায় কয়েকজন মাত্র নির্ভরযোগ্য সহকর্মীদের মধ্যে একজন ছিলেন আতাউর রহমান। প্রথম প্রচুর ইসলামধর্মী সাধারণ মানুষদের দেখলাম দক্ষিণ শহরতলীর লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করতে করতে। কিন্তু তাঁরা কেউই আমার বন্ধু হলেন না। আমার চির-ছিন্নমূল মা-বাবা শেষ বয়সে এসে কলকাতার উপকন্ঠে বসবাস করতে শুরু করলে, প্রথম যে মেয়েটি দৈনন্দিন কাজের জন্য যোগাযোগ করেছিল, সে শুরুতে নিজের নাম মায়া বললেও, দুয়েকদিনের মধ্যে জানলাম তার নাম মুমতাজ। কাজের সুযোগ হারাতে চায় না বলে হিন্দু নাম বলেছিল ! গত বছর দুয়েক আমার ভাইয়ের এক ছাত্র ঈদ-উল-ফিত্র্ উপলক্ষ্যে বাড়িতে তৈরি অতি সুস্বাদু খাবার ভালোবেসে নিয়ে এসেছে। চেটেপুটে খেয়েছি, ফোনে তার আম্মাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। কিন্তু বাড়ি বয়ে দেখা করে আসিনি। আমার নিজের আবাসনে একটি মাত্র ইসলামধর্মী পরিবার রয়েছেন- শিক্ষিত, ভদ্র এই পরিবারের সদস্যেরা দুর্গাপুজো-সরস্বতীপুজোতে সবার সাথে বসে ভোগ খান, চাঁদা দেন। এইসব অভিজ্ঞতার আগে পিছে, প্রথমে অর্কুট এবং তারপরে ফেসবুকের দৌলতে বরং ইসলাম ধর্মাবলম্বী প্রচুর মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে। তাঁরা বেশিরভাগই ভালোবেসে এবং সাফল্যের সাথে শিল্প-সাহিত্য চর্চা করেন; মূলতঃ লেখালিখির সূত্রেই তাঁদের সাথে আলাপ। কিন্তু তাঁদের মধ্যে, এক দু'জন কে বাদ দিলে, কারোর সাথে মুখোমুখি বসে কথা বলার সুযোগ এখনও হয়নি। যাবতীয় যোগাযোগ চ্যাট এবং ফোন মারফতই চলে। তাতে পারস্পরিক সমীহের খামতি না থাকলেও, আমি যে তাঁদের জীবনচর্যার সাথে বিশদে পরিচিত, এমন কথা বলা যাবেনা।
দেখলাম, ইসলাম ধর্মাবলম্বী, আমার চেনা, গল্পের চরিত্র এবং বাস্তবের চরিত্রদের নামের তালিকা একশোর ঘর ও পেরোতে হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে, আমার কি আদৌ উচিত, সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মুসলিম সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষের সম্পর্কে কিছু সিদ্ধান্তে আসা, বা রায়দান করা? সত্যি বলতে গেলে, ইসলাম তো দূরস্থ, আমি সুবিস্তৃত হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কেও কিচ্ছু জানিনা, বা খ্রীষ্টধর্ম , বা শিখধর্ম সম্পর্কেও আসলে কিছুই জানিনা। মাত্র কয়েক বছর আগে আমি 'ইফতার' সম্পর্কে ঠিক ততটাই জানতাম না, যতটা 'লেন্ট' সম্পর্কে জানতাম না। আমি সিরিয়া সম্পর্কে ততটাই জানি না, যতটা আমি হাওয়াই দ্বীপ সম্পর্কে জানিনা। আমার কাছে চীন ততটাই অচেনা, যতটা অচেনা পাকিস্থান। আর হ্যাঁ, আমার কাছে পুরো পশ্চিমবঙ্গের নব্বই ভাগই অচেনা। এই রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বা বিভিন্ন জেলার মানুষেরা কেমন করে দিন যাপন করেন, সেসব জায়গায় রাম-আল্লাহ-মারাংবুরু-তথাগত-মহাবীরের উপাসক কত শতাংশ করে, সে বিষয়েও বিস্তৃত কোনো ধারণা নেই।
কিন্তু একজন সচেতন মানুষ হিসাবে এই ধারণা স্পষ্ট আছে যে, কিছু রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়ী মুনাফাবাজ, সাধারণ মানুষকে ব্যক্তিগত ঈশ্বরউপাসনা আর খাদ্যাভ্যাসের মত দৈনন্দিন বিষয়গুলি নিয়ে লড়িয়ে দিতে দিতে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে যেখানে দেশের মানুষ জরুরী সমস্যাগুলির কথা ভুলে অপ্রয়োজনীয় যত কারণে একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। ধরে নিলাম, এই ব্যাপারটা তথাকথিত ডিগ্রিবিহীন 'অশিক্ষিত' মানুষেরা বুঝতে পারেন না। কিন্তু আমরা যারা শহরে থাকি, নিজেদের প্রবল শিক্ষিত, দেশ-বিদেশ ঘুরে আলোকপ্রাপ্ত মনে করি, যারা নিয়মিত বিবিধ প্রমিত সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে থাকি, ফেসবুকে- হোয়াট্স্অ্যাপে রোজ দিনভর বিশ্বের সব বিষয়ে তর্কের তুফান তুলি, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ কেন মনে করছেন এবং অন্যদেরকে বোঝাতে চাইছেন 'মসীর চেয়ে অসি দড়'? দেশ-দশের বিষয়ে আপনার জ্ঞানগম্যিও যদি আমার মত অতি অল্প হয়, তাহলে ভেবে দেখুন – মুসলমান, হিন্দু, খ্রীষ্টান, বা শিখদের কিংবা সাঁওতাল, নেপালি, লেপচা বা বিহারী, ঝাড়খন্ডী অসমিয়াদের সব বিষয়ে শত্রু ঠাউরে ভালোমন্দ মতামত এবং বিশ্লেষন দেওয়ার অধিকার আপনার আছে কি না !
মহরমের জন্য কেন বিজয়ার ভাসান বন্ধ থাকবে, তাই নিয়ে সুশীল সমাজে ভার্চুয়াল এবং বাস্তব কাজিয়া-কলহের শেষ নেই। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় কোনোদিন ভেবে দেখেছেন কি, পাঁচ দিনের উৎসবকে যখন পনেরো দিন ধরে টানেন, তখন ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে কত মানুষের কত রকমের অসুবিধা হয়? ইস্টারই হোক, বা ঈদ-উজ-জোহা, বুদ্ধ পূর্ণিমা হোক বা গুরুপূর্ণিমা, মহাবীর জয়ন্তী হোক বা স্বাধীনতা দিবস, সব্বার চোখ যে আসলে থাকে ক্যালেন্ডারের পাতায় – সপ্তাহান্ত জুড়ে নিয়ে ছোট্ট করে ছুটির হিসাব নেওয়াটা যে বেশি জরুরী -সেটা কে অস্বীকার করবে?
পৃথিবীর সমস্ত আলাদা আলাদা ধর্মাবলম্বী মানুষেরা সব্বাই একযোগে ভালো বা খারাপ হন না। এমনকী, যারা নাকি তথাকথিত তপস্বী এবং মানবতাবাদী, তারাও যে রাম আর রহিমের নাম একসাথে নিয়েও নরক গুলজার করতে পারে, তার তাজা প্রমাণ এখনও এ দেশের আকাশে বাতাসে থমথম করছে।
'The idea of Otherness' বা 'অপরের ধারণা' নির্মাণ নিয়ে তাত্বিক আলোচনা এই ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয়। করতেও চাই না। 'আমরা' আর 'ওরা'র দ্বন্দ্ব চিরকালীন; আর এই দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিত এবং বিশ্লেষণও একাধিক। পুরুষ-নারী, সাদা-কালো, গরিব -ধনী, ঔপনিবেশিক-আদিবাসী, পূর্ব-পশ্চিম প্রভৃতির মতই হিন্দু-মুসলমান এবং আমরা-ওরা। শুধু এটুকু মনে রাখলেই হয় যে, 'ওরা/ওদের/Them' নামক ধারণা আছে বলেই 'আমরা/ আমাদের/We/Our/Us' -এর ধারণাটিও টিঁকে আছে। এই বিবিধতা এবং দ্বন্দ্ব আছে বলেই আমাদের প্রত্যেকের জীবন ব্যক্তিগতভাবে এবং সামূহিকভাবে বহু ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতার প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ।
'আমরাও মানুষ, ওরাও মানুষ' – এই সহজতম এবং প্রাথমিক সত্যটাকে যদি নিজেরা নতুন করে বুঝতে এবং মেনে নিতে পারি, তাহলে হয়ত আমাদের নিজেদের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ওঠা সন্দেহ-দ্বেষ-হিংসা-অসহনীয়তা-নীচু মানসিকতার প্রাচীরটা ধীরে ধীরে ভেঙে ফেলতে পারব। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে গুচ্ছের অপ্রয়োজনীয়, ভুল এবং মিথ্যা খবর , শুধুমাত্র 'শেয়ার' করার তাগিদে 'শেয়ার' না করে, আপাতদৃষ্টিতে যা দেখতে পাচ্ছি, তার পেছনের আসল ছবিটা দেখতে পারা, বুঝতে পারা অনেক বেশি জরুরী।
চাচাকে সেদিন যে উত্তর দিতে চেয়েছিলাম সেই উত্তরটা আজও পুরো মনের মত তৈরি হয়নি। তবু আমি নিশ্চিত, এর পরের যেদিন যাব, সেদিনও তিনি হাসিমুখে আমার হাতে আবার বাদাম-পেস্তা তুলে দেবেন। আজও এইটুকু আস্থা মুখতার চাচার মত এদেশের কোটি কোটি তথাকথিত 'অশিক্ষিত' মানুষদের ওপর আমার আছে।
Published in Soi-Sabud: http://www.soicreativewomen.org/blog/silence-like-a-cancer-grows-blog-series/71-aamra-ora-mahasweta-ray.html