সপ্তাহ খানেক আগে, গত শনিবার, ছিল কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা। বেশিরভাগ বাঙালি হিন্দু পরিবারের মত আমার বাড়িতেও এই পুজো হয়। পুজোর অঙ্গ হিসাবে মন্ত্র এবং পাঁচালীর সঙ্গে থাকে ব্রতকথা পড়ার নিয়ম। ব্রতকথা হল সাধারনতঃ একটি অলৌকিক গল্প, যেখানে সাধারন মানুষের নানা সমস্যা এবং তার সমাধানের মধ্যে দিয়ে আরাধ্য দেব-দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার হয়। এইসব ব্রতকথা একসঙ্গে করে “মেয়েদের ব্রতকথা” বা “বারোমাসের ব্রতকথা” – এই ধরনের নাম দিয়ে সঙ্কলন আকারে প্রকাশ করা হয়।
আমাদের বাড়ীর পুজোয় দুটি ব্রতকথা বলা হয়। তার মধ্যে একটি পড়া হয়ে এই ধরনের একটি বই থেকে; অন্যটি আমার ঠাকুমার স্মৃতি-নির্ভর। দুটি গল্পই নানারকমের বাঁক ঘুরে শেষ অবধি মা লক্ষ্মীর ক্ষমতা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করে। মুশকিল হল, গল্পের ফাঁক-ফোকর এত বেশি যে, আমরা যারা পড়ি এবং শুনি, তারা প্রতিবারই পাঠ চলাকালীন নানাবিধ যুক্তি এবং প্রশ্ন খাড়া করি- শেষ অবধি ব্যাপারটা হাসাহাসি করে শেষ হয়। এতে মা লক্ষ্মী রেগে যান, না কি অবোধ সন্তান বলে আমাদের মাপ করে দেন ঠিক জানিনা, তবে প্রতি বছরই একই ব্যাপার ঘটে আমাদের বাড়ীর পুজোয়।
যে গল্পটি নিয়ে এত কথা, সেই গল্পটি বলি এবার। অন্যান্য বারের মত এইবারো আমিই ব্রতকথাটি পাঠ করে এসেছি সদ্য সদ্য, তাই গল্পটা একদম ঠিকঠাক বলছি, গল্পের বাঁক এবং গতি মেনেঃ
এক দেশের রাজার নিয়ম ছিল যে তাঁর রাজ্যে কোন জিনিষ বিক্রি না হলে তিনি সেটা কিনে নেবেন। একদিন এক কামার এক লোহার অলক্ষ্মী মূর্তি বানিয়ে হাটে বেচতে নিয়ে এল। সেট কেউ কিনলো না। তখন সে রাজার বাড়ির সামনে এসে হাঁকাহাঁকি করায় তিনি সেট উচিত মূল্যে কিনে নিলেন।
সেদিন রাত্রে রাজপ্রাসাদের ভিতর মহিলার কান্নার আওয়াজ শুনে রাজা এসে দেখলেন এক পরমাসুন্দরী কন্যা কাঁদছেন। তাঁকে রাজা জিজ্ঞেস করলেন- আপনি কে মা,এখানে বসে কাঁদছেন কেন? তাতে সেই মহিলা বললেন- আমি তোমার রাজ্যলক্ষ্মী, তুমি বাড়িতে অলক্ষ্মী কিনে এনেছ, তাই চলে যাচ্ছি। বলে তিনি চলে গেলেন।
এইভাবে পরের দুই রাত চলে গেলেন ভাগ্যলক্ষ্মী আর যশোলক্ষ্মী। তার পরের রাতে এক পুরুষ আর আরেকজন নারীকে বেরিয়ে যেতে দেখে রাজা তাঁদের আটকালেন। সেই পুরুষ বললেন তিনি ধর্ম, আর নারী কূললক্ষ্মী। রাজা ধর্মকে বললেন- আপনি আমাকে ছাড়তে পারবেন না। সেই কথা শুনে ধর্ম থেকে গেলেন। কূললক্ষ্মী চলে গেলেন। তবে তিনি চলে যাওয়ার আগে রাজাকে বর দিয়ে গেলেন যে এখন থেকে রাজা সব পশু-পাখির কথা বুঝতে পারবেন।
ক্রমে রাজ্যে এবং রাজার জীবনে অশান্তি নেমে এল। একদিন রাজা অরুচি হওয়ার জন্য রানীকে বারন করলেন রান্নায় ঘি দিতে। তাঁর খাবার সময় পাতের চারধারে প্রচুর পিঁপড়ে জমা হত। সেদিন পিঁপড়েরা খাবারের কণা মুখে দিয়ে বলাবলি করতে লাগল- রাজার কি দুর্দিন, খাবার ঘি ও জোটেনা। তাই শুনে রাজা হা হা করে হেসে উঠলেন। সেই হাসি শুনে রানী জানতে চাইলেন কেন তিনি হাসছেন। রাজা বলতে চাইলেন না, রানীও ছাড়লেন না। রাজা বললেন- একথা বললে আমার প্রাণ যাবে, তাও তুমি শুনতে চাও? রানী বললেন- হ্যাঁ, শুনতে চাই। অগত্যা রাজা রানীকে বললেন- নদীর ধারে চল, সেখানে গিয়ে বলব।
নদীর ধারে গিয়ে রাজা দেখলেন নদীর মাঝখান দিয়ে একটা মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে। তাই দেখে নদীর পাড়ে বসা এক শেয়ালকে, শেয়ালনী বলছে- যা, গিয়ে মড়াটা নিয়ে আয়, দুজনে মিলে খাই। তাই শুনে শেয়াল বলল- আমি তো আর রাজার মত বোকা নই যে রানীর কথায় প্রাণ দেব। এই কথা শুনে রাজা রানীকে সেইখানে ছেড়ে দিয়ে এক দৌড়ে রাজ্যে ফিরে চলে গেলেন।
রানী নদীর পারে মলিন বস্ত্রে ঘুরে ঘুরে বেড়ালেন। তারপর একদিন দেখতে পেলেন, আশ্বিন মাসের কোজাগরী পূর্নিমার রাত্রে কয়েকজন মহিলা খই, মুড়কি, নারকোল আর তালের ফোঁপল এবং অন্যান্য আনুসঙ্গিক দিয়ে পুজো করছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন এটা কি পুজো। তারা জানালে এ হচ্ছে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা। তখন রানী তাদের সঙ্গে বসে পুজো করলেন এবং সারা রাত গান-গল্প করে জেগে কাটালেন।
পরদিন ভোরবেলা রাজার প্রাসাদে বিষম শব্দ করে অলক্ষ্মীর মূর্তি ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল। ধর্ম এসে রাজাকে বললেন- অলক্ষ্মী দূর হয়েছে, আপনি শিগগির রানীকে ফিরিয়ে আনুন। রাজা তখন পালকি বেহারা পাঠিয়ে রানীকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। রাজ্যে সুখ-সমৃদ্ধি ভরে উঠল।
গল্প শেষ। কিন্তু সত্যি শেষ হল? এই গল্পটি আমাদের সবার মনে রেখে যায় বেশ কয়েকটি প্রশ্ন। যেমনঃ
১। ধর্মের নিজের কি কোন মতামত নেই? প্রথমে তিনি কূললক্ষ্মীর সাথে রাজাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, তার পর রাজা একবার মিনতি করতেই মত বদল করলেন?
২। কূললক্ষ্মী বর দেওয়ার সময় বলেন নি অন্য কেউ জানলে রাজার মৃত্যু হবে। তাহলে সেই কথা পরে এল কেন?
৩। রানীর কি ভয়ানক জেদ- রাজার মৃত্যু হবে জেনেও তাঁর লুকানো কথা শোনার কি প্রবল আগ্রহ…
৪। যে রাজা কিছুক্ষণ আগে রানীর কথায় বাধ্য হয়ে নদীর ধারে গেলেন লুকানো কথা বলতে, তিনিই শেয়ালের কথা শুনে মূহুর্তে মত বদল করলেন
৫। রাজা তারপর রানীকে ভুলেই গেলেন, আর ততদিন খোঁজ নিলেন না, যতদিনে আবার ধর্ম এসে মনে করিয়ে দিলেন
৬। গল্পের শুরু যে সমস্যা নিয়ে, সেখানে কিন্তু রাজার কোন ভুল নেই। তিনি তো রাজধর্মই পালন করছিলেন। তাহলেও তার জীবনে এত সমস্যা কেন?
৭।রাজ্যলক্ষ্মী, ভাগ্যলক্ষ্মী, যশোলক্ষ্মী, কূললক্ষ্মী- সবাই মিলে একসঙ্গে একা অলক্ষ্মীর বিরুদ্ধে হতে পারলেন না? শেষ অবধি কিনা বেচারি রানীকে বিশেষ ভাবে কোজাগরী করতে হল এই সমস্যার সমাধানের জন্য?
৮।এইটাই যদি সমাধান হবে- তাহলে প্রথমেই তো রাজাকে সমাধান বলে দিলে হত!
এইরকম আরো নানা প্রশ্ন আমাদের মনে এবং মুখে ঘোরাফেরা করে। আমি এই পোস্টে , যে বই থেকে এই গল্পটি পড়া হয় তার নাম বা প্রকাশক/সম্পাদকের নাম বলছি না। এখানে কারোর সমালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। ব্রতকথাগুলি কোন একজনের লেখা নয়, তাই বইটিতে সম্পাদক এবং সংশোধনকারীর নাম আছে। ব্রতকথাগুলি মূলতঃ মুখে মুখেই ঘুরত, যেমন আমার ঠাকুমার বলা দ্বিতীয় গল্পটি, যেটা কোন বইতে পাওয়া যায় বলে জানি না। যে গল্পতে লক্ষ্মীর ছেলের নাম কুবের আর মেয়ের নাম- ঢুস্না -পাবনার ভাষায় যেটা হয়ে যায় ঢুইশন্যা!!- যে গল্প আমাদের মধ্যে আলোচনার সৃষ্টি করে মা লক্ষ্মীর নামপছন্দের রকম-সকম নিয়ে!
ওপরের গল্পটি নিয়ে আমি আলোচনা করলাম কারন এই গল্পটি যতবারই পড়ি, ততবারই ওপরের প্রশ্নগুলি মাথায় চলে আসে। এই গল্পের কোন নারীবাদী বা মানবতাবাদী তত্ব বিশ্লেষণ করতে চাই না। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, রানীর ওপর অকারণে কত ঝড়-ঝাপ্টা গেল। সমস্যা তৈরি করলেন রাজা, কিন্তু তার সমাধান এল শেষ পর্যন্ত রানীর হাত ধরে। যতক্ষণ না এল, ততক্ষন রানী কিন্তু তাঁর হারানো জায়গা ফিরে পেলেন না।
হয়ত আরেকটু গভীর ভাবে ভাবলে, এইসব গল্পগাথা-ব্রতকথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের প্রাচীন সমাজব্যাবস্থার, ধ্যান-ধারণার টুকরো টুকরো চিত্র। আর সেইসব চিত্রগুলি হয়ত সবগুলিই প্রাচীন নয়, হয়ত সেইসব ধ্যান-ধারণার কিছু কিছু আজও বর্তমান, খানিকটা পরিশীলিত রূপে – সেই সব ভাবনা-চিন্তা, ধ্যান-ধারণা, যেগুলির সঙ্গে আধুনিক পুরুষ এবং নারী নিজ নিজ ক্ষেত্রে এখনও লড়াই করে চলেছে।
তাই মনে হয়, পুজোর শেষে নাড়ু-মুড়কি খেতে খেতে এবং তালের ফোঁপলের ভাগ নিয়ে ভাই-বোনেদের সাথে ঝগড়া করতে করতে আমরা আলোচনা চালিয়েই যাই…বছরের পর বছর, প্রতি কোজাগরীতে।
এই পোস্টটি কফিহাউসারাড্ডা ব্লগেও প্রকাশিত হয়েছে।
একটি ব্রতকথা নিয়ে দু-চারটি আরো কথা
- Details