ছবি ১
ছোট্ট মেয়ে। বয়স পাঁচ বা ছয়। ঝকঝকে সকাল। একটা পুরোনো বাড়ির পাশের ইঁট বাঁধানো গলি। এককোনায় একটা লাল জনতা স্টোভের ওপর বসানো কালো হাঁড়ি। টগবগ করে জল ফুটছে। সামনে বসে দুই পিসি। ফুটন্ত জলের মধ্যে নেচে বেড়াচ্ছে শুকনো শিউলির বোঁটা। আর পাক খাচ্ছে একফালি লম্বাটে কাপড়ের টুকরো। মেয়েটা লাফাতে লাফাতে কাছে এলেই পিসিরা বলছে দূরে যাও, দূরে যাও… একটু পরে একটা লাঠির ডগায় জড়িয়ে বেড়িয়ে এল ফ্যাকাশে হলদেটে-কমলাটে রঙা সেই কাপড়ের ফালি। শিউলির বোঁটায় রাঙানো পুতুলের শাড়ি।



ছবি ২
সন্ধ্যাবেলা। দুই ভাই বোনের খুব ব্যস্ততা। কাল সরস্বতী পুজো। মায়ের আলপনা আঁকা হয়ে গেছে। বাবা বাজার থেকে নিয়ে এসেছেন মাটির দোয়াত, খাগের কলম। তবে মূর্তি নেই। মা বলেছেন ঠাকুরঘরের পটকেই পুজো করা হবে। একটু মন খারাপ…সবার বাড়ি মূর্তি আসে…কিন্তু কি আর করা…বাবা, মা দুজনেরই যে স্কুলের দায়িত্ব, তাই বাড়ির পুজো তাড়াতাড়ি শেষ করে স্কুলে যেতে হবে… আজ রাতে ঠাকুরের পায়ের কাছে সব বই রাখতে হবে যে…বিষয় মিলিয়ে সব বিষয়ের বই সাজায় দুইজনে। কোন বই ভুললেই মুশকিল! মা সরস্বতী আর সেই বিষয়ে কোন সাহায্য করবেন না !! বাবারে, এই ভুল করা যায় কখনো…বাবা যতই বলুন না কেন যে সব বই দেওয়ার দরকার নেই, সে কথা শুনছে কে?



ছবি ৩
সকাল থেকে খুব মন খারাপ। এতদিনের কুল না খেয়ে থাকা কোন কাজে লাগলো না আর। ঘুম থেকে উঠে, অঞ্জলি দেওয়া হয়নি, প্রসাদ খাওয়া হয়নি, মা সরস্বতীর কাছে ভালো করে প্রার্থনা করা হয়নি, আর চোখ কিনা সোজজা চলে গেল গতকালের খবরের কাগজের ওপর আর সে যে পড়ে ফেলেছে বড় বড় অক্ষরে লেখা প্রথম লাইন! এইবার কি হবে! কে না জানে যে সরস্বতী পুজোর দিন মোটেও পড়শোনা করতে নেই, অক্ষরের দিকে তাকাতেই নেই…কি যে হবে…মা সরস্বতী নির্ঘাত রেগে গেলেন একটু…



ছবি ৪
গোলাপি আর সাদা সালোয়ার কামিজ পরা বছর তেরোর মেয়েদুটি হাঁটছে বাস রাস্তার দিকে। স্কুলে যাচ্ছে স্কুলের পুজো দেখতে। আজ স্কুল বাস নেই। তাতে কি? আজকেই তো বড় হওয়ার দিন। ক্লাস সেভেন। এই প্রথম একলা একলা পাবলিক বাসে চেপে সরস্বতী পুজোর দিন স্কুলে যেতে দিতে রাজি হয়েছেন বাবা-মারা। তবে শাড়ি পড়ে বাসে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেলে বা পড়ে গেলে কি হবে? তাই শাড়ির বদলে সালোয়ার কামিজ ই সই। স্কুলের গেটের সামনে এসে হাঁ ! সামনে কাতার দিয়ে সাইকেল, স্কুটার, মোটরসাইকেল আর অগুন্তি নানাবয়সী ছেলে !! নিজেদের স্কুলে নিজেরাই ঢোকা দায়। কোনমতে ঢুকে ঠাকুর দেখে, প্রসাদের প্যাকেট যোগাড় করে, ভীড়ে থতমত দুজনে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দেখতে পাচ্ছে এদিক-ওদিক, প্রচুর সাজগোজ করা মেয়েরাও আছে, কিন্তু মেয়েদের স্কুলে একতলা, দোতলা, এমনকি ছাতেও- এত এত ছেলে? তাদের জামার কাট, চুলের ছাঁট, কপালের ওপরে তোলা সানগ্লাস- সবই তো খুব চেনা, কিন্তু চোখের দৃষ্টি, শরীরের ভঙ্গী-মাঝে মাঝে এত অচেনা লাগে কেন? অচেনা অনুভূতির হটাত ধাক্কায় কিছু ভয়, কিছু উত্তেজনা, কিছু গা শিরশির নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে দুজনে। বড় হওয়ার রোমাঞ্চ যে বড় গোলমেলে…



ছবি ৫
ছেলেটা গেছে তার বন্ধুদের সাথে চাঁদা তুলতে সরস্বতী পুজো করবে বলে। সব ছেলেরা করে, তারাই বা বাদ কেন? তবে সঙ্গি-সাথী মোটে তিন-চারজন। তাতে কি? পাশের বাড়ি গিয়ে দরজায় ঠকঠক। জেঠু দরজা খুলে বললেন
-কি চাই?
-আমরা সরস্বতী পুজো করবো, চাঁদা চাই।
-কত চাঁদা?
-তোমার যা ইচ্ছা দাও।
চাঁদা আদায়কারি ছেলেটার এহেন দাবী শুনে হেসে উঠলেন জেঠু। বললেন -এভাবে চাইলে তো কম দেওয়া যাবে না। আচ্ছা যা দশ টাকা দিলাম।
সেই একবারই ছেলেটা পুজো নিয়ে উতসাহ দেখিয়েছিল। সেই দশটাকাটা ছিল সেবারের সব থেক বেশি চাঁদা।



ছবি ৬
বাবার খুব ফুল গাছের শখ। শীতে তাই বাগান ভরা বাসন্তী-কমলা গাঁদা, লাল-মেরুন- গোলাপি ডালিয়া, হলুদ, সাদা চন্দ্রমল্লিকা। আগুন রঙা বৈজয়ন্ত। ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকারা টবে, কিন্তু গাঁদারা সবাই বাড়ি ঢোকার পথের পাশে কেয়ারি করা। তাই টবেরা সরস্বতী পুজোর আগের দিন বিকেলে ঢুকে গেল ঘেরা বারান্দার ভেতর। আর পরদিন সকালবেলা যা ভাবা গেছিল, তাই হল। হলুদ কমলায় সেজে থাকা উজ্জ্বল বাগানটা এক রাতের মধ্যে হয়ে পড়েছে রংহীন, জৌলুশহীন। ভোর রাতে দুষ্টু ছেলের দল সমস্ত ফুল তুলে নিয়ে গেছে যে!



ছবি ৭
মেয়েটা ক্লাস ইলেভেন। শাড়ী-টাড়ী পড়ে অন-নে-এ-ক বড়। স্কুল এর পুজোর সেক্রেটারি। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে নিঃশ্বাস ফেলার যোগাড় নেই।বন্ধুদের উতসাহে এবং তার উদ্যোগে নিয়মের মাঝে একটু বদলের হাওয়া …এইবার প্রথম স্কুলের বিশাল হলের মেঝে জুড়ে সাবেকি সাদা আলপনার বদলে রঙিন বালির আলপনা। স্কুলের উঁচু ক্লাসের মেয়েরা তাই অফ পিরিয়ডে বসে বালি চালছে, তাতে আবির মেশাচ্ছে, আলাদা আলাদা রঙের বালি তৈরি হচ্ছে, আর ধীরে ধীরে স্কুলের হলের মাঝখানে ফুটে উঠছে রঙিন কার্পেটের মত বালির আলপনা। চারপাশে হাঁ মুখ নিচের ক্লাসের মেয়েদের ভীড়। বড় দিদিদের হাতের কাজ দেখছে অবাক চোখে। …পুজোর দিন বিশিষ্ট অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন স্বয়ং বড়দিদিমণি !…সকলের প্রশংসা শুনে বাইরে এসে বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে খুশির আমেজ, সাফল্যের উত্তেজনা…আর রাশি রাশি ছেলেদের ভীড় দেখে সেই নাম-না-জানা-উত্তেজনা?- না…এখন আর সেই ভয়টা নেই, বরং এসেছে একটা দেখেও-দেখছি-না-বুঝেও-বুঝছি-না ভাব… !



ছবি ৮
পুজোর দুইদিন পরে স্কুলে খিচুড়ি খাওয়া। কোমরে আঁচল জড়িয়ে খিচুড়ির বালতি আর বেগুনির ঝুড়ি নিয়ে সার দিয়ে বসা মেয়েদের মাঝখান দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশ যাচ্ছে কিছু মেয়ে। ভারি বালতি হলে সাহায্য করছেন মাস্টারমশাইরা। এ কদিন সবাই যেন সবার বন্ধু। স্যার বা দিদিমণিদের একয়দিন একটু কম ভয় পেলেও চলে।



ছবি ৯
উত্তর কলকাতার মেয়েদের কলেজ হোস্টেল। সকালে পুজো, দুপুরে খিচুড়ি, সন্ধ্যেবেলা অতিথি আপ্যায়ন (আশেপাশের ছেলেদের হোস্টেল থেকে ছেলেরা ) এবং অন্যান্য হোস্টেল পরিদর্শন (বিশেষ করে আশেপাশের ছেলেদের হোস্টেল গুলি )। এই একটা দিনই তো সব কিছুর ছাড়…কিছু চোখে চোখে কথা, কিছু ভদ্র আলাপচারিতা, আর অনেক না বলা তথা, না মেটা কৌতূহল…মেট্রনও প্রায় দেখেও না দেখার ভান করেন। পুজোর পরের দিন ভাসান দিয়ে এসে সারা রাত ধরে তিনরকমের ফিল্ম দেখা- বাংলা, হিন্দি আর ইংলিশ – যাতে কেউই অখুশি না হয়। সরস্বতীর ভাসান দিয়ে এসে সবাই নাকি ভাং খায়, আমরা খাবো না? নিশ্চয় খাবো- একদন সাহসিনীর ঘোষনা। একফোঁটাও খাবোনা, জানায় অন্য দল। প্রায় বন্ধ বাজার থেকে কিনে আনা হয় ভাং, আর গুঁড়ো পাউডার গুলে দুধ বানিয়ে, তাতে ভাং গুলে খাওয়া হয়। যারা খায় আর যারা খায়না- ফলাফল একই !! চল্লিশজন মেয়ের মোকাবিলা করতে পারে কি মোটে দুই-তিন মুঠো ভাং !!

ছবি ১০
পুজোর পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাটির দোয়াতে খাগের কলম ডুবিয়ে বেলপাতায় তিনবার করে লিখছে দুই ভাই বোন- শ্রী শ্রী সরস্বতৈ নমঃ। তারপর দধিকর্মা -দই-চিঁড়ে-ফল সব দিয়ে মেখে খেতে কি ভালো। মা বলছেন- মা সরস্বতীর পায়ের ফুল সব বইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখো। আর আজকে সারাদিন খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হয়…
হোস্টেলে খাগের কলম দোয়াত আলাদা করে জোটে না, তাই খাতার পাতাই সই…শেষ দুপুরে সবার সাথে লরিতে উঠে গঙ্গার ঘাটে ভাসান দিতে গিয়ে যখন মূর্তিটা ধীরে ধীরে ডুবে যেতে লাগলো পড়ন্ত সূর্যের আলোয় চিকচিক করতে থাকা জলের তলায়, তখন দুচোখ ভরে শুধু জল…