এই সময়, এই জীবন
- Details
বেশ কয়েকদিন ধরেই ভাবছি কিছু বিষয় নিয়ে লিখব। কিন্তু গত আট-দশ দিনের ঘটনার ঘনঘটায় সেটা আর হয়ে উঠছিল না। কিন্তু আর দেরি করব না। এবার লিখেই ফেলি।এই লেখার শুরুতেই জানিয়ে রাখি, আমার লেখা কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। আমি "রাজনীতি"র কিছুই বুঝি না। আমার পরিবারে কেউই সক্রিয় রাজনী্তির সাথে যুক্ত নন, তাই কোন রকম সরাসরি অভিজ্ঞতা আমার নেই। স্কুল এবং কলেজে চার বছর পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়েছি বটে, কিন্তু খুব মন দিয়ে পড়েছি, বা সব বুঝে পড়েছি, এই কথা বললে ভুল বলা হবে। বহু প্রচারিত, বহু আলোচিত, বহু ব্যবহৃত কোন সামাজিক -রাষ্ট্রনৈতিক '-বাদ'/ -ইস্ম নিয়ে কোন রকমের তাত্বিক আলোচনা করার যোগ্য আমি নই।
- Details
ইন্দিরাদির লেখাটা পড়ে মনে হল একটু কালার সাইকোলজি, বা রঙের মনস্তত্ব নিয়ে কথা বলা যাক।যাঁরা একটু রঙ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন (অথবা করেন না), ছবি-টবি আঁকেন (অথবা আঁকেন না)- তাঁরা মোটামুটি সবাই জানেন সবুজ রঙ তৈরি হয় দুটো প্রাথমিক রঙ - নীল আর হলুদ মিশিয়ে।যদি নীল আর হলুদ কে আলাদা করে ধরি, তাহলে বলি, নীল হল খোলা আকাশ, দিগন্ত বিস্তৃত সাগরের (আর লেকের) জলরাশির রঙ; নীলের সাথে জড়িয়ে আছে মুক্তচিন্তা, বিশ্বাস এবং প্রাজ্ঞতার আশ্বাস। আর আধুনিক জীবনে, নীল অবশ্যই পেশাদারিত্বের/প্রফেশন্যালিস্ম্ এর রঙ - একটু ভেবে দেখুন দেখি- আমাদের আশেপাশের কতগুলি সফল বহুজাতিক সংস্থার লোগোতে ব্যবহার করা হয়েছে নীল ?আর হলুদ - হাসিখুশি হলুদ হল প্রানোচ্ছলতা, স্ফূর্তি, আনন্দ আর উচ্ছলতার রঙ, আবেগের রঙ । ইয়াহু মেসেঞ্জার বা জি-টক, অথবার কফিহাউসের জাজু ইমোটিকন্স্- সব স্মাইলিরই কিন্তু প্রাথমিক রঙ হলুদ। স্কুল বাসের রঙ হলুদ। বাঁদরলাটির রং-ও ।আবার আরেকদিক থেকে দেখতে গেলে, কালার হুইলে নীল পড়ে শীতল রঙ/ কুল কালার্স্ এর দলে, আর হলুদ পরে উষ্ণ রঙ/ ওয়ার্ম কালার্স এর দলে।পশ্চিম বঙ্গে গত ১৩ই মে যে সবুজের জোয়ার এল (সুনামি বলব না, সুনামি বড় ভয়ানক সব স্মৃতি বহন করে আনে) , সেই জোয়ারের কথা মাথায় রেখেই বলি, এই সবুজে থাক নীল আর হলুদের সঠিক মিশেল - তৈরি হোক এক সজীব সবুজ - যেখানে পেশাদারিত্বের সাথে থাকবে সংবেদনশীলতা, মুক্তচিন্তা এসে মিশবে আবেগের সাথে, প্রাজ্ঞতার সাথে মিশে যাবে প্রানোচ্ছলতা। এ সবুজ হোক নাতিশীতোষ্ণ - চোখজোড়ানো, মন ভরানো। সবুজ যে প্রকৃতির রঙ, সজীবতার রঙ, আশার রঙ।[তা বলে লাল কি খারাপ রঙ? আমরা তো জানি লাল হল ভালবাসার রঙং। প্যাশনের রঙ। কৃষ্ণচূড়ারও রঙ। কি করে যে বদলে হয়ে গেছিল শুধুমাত্র রক্তের, লালফিতের আর সাদা অ্যাম্বাসেডরের মাথায় বাতির রঙ - কে জানে! ][ ইন্দিরাদির পোস্টে কমেন্ট রূপে প্রকাশিত কফিহাউসেরআড্ডার এই পাতায়]
- Details
এই শরতে আমার জীবনে এল এক বড় পরিবর্তন। আমি ছোট্টবেলা থেকে যে প্রান্তিক শিল্পনগরীতে বড় হয়েছি, খেলে বেড়িয়েছি, স্কুলে গেছি, সেই রূপনারায়ণপুর ছেড়ে আমার বাবা মা পুরোপুরিভাবে চলে এলেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কোদালিয়ায়, একটি নবগঠিত আবাসন প্রকল্পে। খোলা বাগান, রোদেভরা উঠোন, দখিন খোলা চাঁদ-সূ্য্যি ঢালা বারান্দার জায়গা নিল দুই কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট। এই সিদ্ধান্ত না নিয়েও উপায় ছিল না। কলকাতা থেকে যাতায়াতে প্রায় সাত-আট ঘন্টা সময় লেগে যায়। আমি বা আমার ভাই কাজকর্মের চাপে বছরে বার দুয়েকের বেশি যেতে পারতাম না। যে কোন কারণবশতঃই হোক, ওদিকে চিকিতসা ব্যবস্থাও খুব একটা সুবিধাজনক হয়ে ওঠেনি। আমার বাবা মাও চাইছিলেন আমাদের কাছকাছি থাকতে। তাই সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পাট গুটিয়ে চলে আসা হল।
- Details
আমার এবারের পুজো খূব ব্যস্ততায় কাটছে। তাই ইচ্ছা থাকলেও পুজোয় নতুন পোস্ট দিতে পারছি না। মনের মধ্যে নানা কথা ঘুরছে ফিরছে, কিন্তু লেখার সময় নেই। কেন নেই, সেটা বলার জন্যও সময় চাই।
হাজার ব্যস্ততার ফাঁকেও আজ ষষ্ঠীর সন্ধ্যাবেলা কিছু পড়শির সাথে বেরিয়েছিলাম পাড়ার কাছাকাছি ঠাকুর, বা বলা ভাল, মন্ডপ দেখতে। বিশাল বিশাল মূর্তি, প্রচুর আলো, অসাধারণ পরিশ্রমে সৃষ্ট শিল্পকলায় সাজানো মন্ডপ…চোখ জোড়ানো, মন ভোলানো। পাঁচটাকা দিয়ে প্লাস্টিকের বাঁশি কিনে ফেললাম – ফুঁ দিলেই সামনে লাগানো গোটানো অংশ হাওয়া পেয়ে লাফিয়ে উঠছে…সঙ্গী ছোটদের সাথে পাল্লা দিয়ে বাশিঁ বাজালাম, আইসক্রিম খেলাম, ঘটি-গরম খেলাম, লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ঠাকুর দেখলাম…
এত আলো, এত আনন্দের মধ্যে হঠাত চোখে পড়েছিল রাস্তার ধারে শ্রান্ত, ক্লান্ত, দীন এক শরীর …হুল্লোড় – রোশনাই এর তোয়াক্কা না করে ঘুমিয়ে আছে…অথবা সে হয়ত অসুস্থ এবং অভুক্ত…
গত মাস দুই তিনেক যাবত খবরের কাগজে এবং টিভি চ্যানেলে অনেক ছবি দেখেছি – খরার ছবি, বন্যার ছবি, ধ্বংসের ছবি, দুর্ঘটনার ছবি, যুদ্ধের ছবি – সেইরকমই এক ছবি এঁকে ফেলেছিলাম কোন এক মূহুর্তে। অনেক দুর্গার পুজো হয়ত এইরকমই হয়।
বাড়ী ঢোকার আগে প্লাস্টিকের লাল রঙের বাশিঁটা দিয়ে দিলাম আমার আবাসনের পুজোয় যিনি ঢাক বাজাতে এসেছেন, তাঁর ছোট্ট ছেলেকে। ওর নাম অবশ্য জানিনা – হতে পারে গনেশ , বা কার্তিক…
- Details
আমি কম্পিউটার ব্যবহার করছি গত এগারো বছর ধরে। এই এগারো বছরের মধ্যে কম্পিউটারের নানারকম সফটওয়্যার আমাকে নানাভাবে আকৃষ্ট করেছে। আমার প্রথম ভালোলাগা ছিল গ্রাফিক সফটওয়্যারগুলি, কারন সেগুলি ব্যবহার করে নানারকম ছবি আঁকা যেত। প্রথম ব্যবহার করতে শিখেছিলাম MS Paint, তারপরে Adobe Photoshop, CorelDraw, Flash, যখন যেটা দরকার পড়েছে, শিখেছি। যখন থেকে ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচিত হলাম, তখন থেকে শুরু হল এক অন্যরকম উতসাহ। নতুন নতুন বিষয় জানা, জানা বিষয়ে অজানা তথ্য আবিষ্কার করার এক নতুন নেশায় মেতে গেলাম। কিন্তু এই ডিজিটাল দুনিয়ায় যে বিষয়টি আমাকে একেবারেই উতসাহিত করেনি, সেট হল কম্পিউটার গেমস। আমার ভাই যখন সেই বিখ্যাত মোটরসাইকেল রেসের খেলা "রোডর্যাশ" খেলত, আমি মাঝে মাঝে পাশে বসে দেখতাম। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে আমার যেটুকু উতসাহ ছিল সেটা ছিল ঐ গেমটি তে ব্যবহার করা বিভিন্ন ল্যান্ডস্কেপ গুলি নিয়ে - কোনটা সমুদ্রের ধার দিয়ে, কোনটা বা শহরের মধ্যে দিয়ে, কোনটা বা উঁচু নিচু উপত্যকার মধ্য দিয়ে। ঐ গেমটি দেখার মূল আকর্ষণ ছিল গ্রাফিক্সগুলির মাধ্যমে আমেরিকার বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটু আভাস পাওয়া। কিন্তু এছাড়া আর কোন উতসাহ ছিল না। আমি এমনকি মোবাইল ফোনের গেম গুলিও খেলি না। উইন্ডোস এর সাথে আসা তাস বা অন্যান্য কোন গেমগুলিকে খেলিনি কোনদিন।
অথচ ইদানীং গত দুই-তিন মাস ধরে, আমার যাবতীয় মনোযোগ আকর্ষণ করে নিয়েছে ফেসবুকের বহুল জনপ্রিয় তিনটি গেম - প্রথমে ফার্মভিল [Farmville] , তারপরে ক্যাফে ওয়্ররল্ড [Cafe World], এবং শেষ কিছুদিন যাবত ফিশভিল [Fishville]। ফার্মভিলে নানারকম ভার্চুয়াল ফসল ফলানো যায়, গরু-ছাগল-মুর্গি ইত্যাদি পালন করা যায়; ক্যাফে ওয়ররল্ড এ নিজের ক্যাফে খুলে সেখানে নানারকম রান্না করে বিক্রি করে ক্রেতাদের খাওয়ানো যায়; আর ফিশভিলে নিজের অ্যাকুয়ারিয়মে নানারকম মাছ চাষ করা যায়। বলাই বাহুল্য , চাষের ফসল-ফল-ফুল, ক্যাফের খাবারদাবার এবং অ্যাকুয়ারিয়মের মাছ, সবই বিক্রয়যোগ্য। বিক্রি টাকা রোজগার করে আবার নতুন বীজ কিনে চাষ, বা নতুন খাবার তৈরি করা যায়। এইভাবেই পয়েন্ট বাড়ানো, লেভেল বাড়ানো, নিজের খামারের বা ক্যাফের আয়তন এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধি...। -সমস্ত ধাপগুলিই ভার্চুয়াল, তবে কেউ যদি অত্যধিক উতসাহি হন, তাহলে চটজলদি লেভেল বাড়ানোর জন্য গেমগুলির মালিক জিঙ্গা কে সত্যি সত্যি টাকা দিয়ে একলাফে অনেক ধাপ পেরিয়ে যেতে পারেন।
আমার অত টাকা নেই, তাই আমি ভার্চুয়াল টাকা পয়সার ওপরই নির্ভরশীল। তাই ব্যবহার করে করেই আপাতত আমি একখানা বেশ বড়সড় খামারের মালিক। তাতে নেই নেই করে দুটি বাড়ি, একগাদা গরু-ভেড়া-ছাগল-হাঁস-মুর্গি -কি নেই!! সেই খামারে আমি ইচ্ছামত ধান-গম-ভুট্টা-আঙ্গুর-স্ট্রবেরি-কুমড়ো-আরো কত কি দেশি-বিদেশি ফসল ...যখন যেমন খুশি চাষ করতে পারি। আবহাওয়া-রোদ-জল-মেঘ-বৃষ্টি-মাটি- গ্রামীণ ব্যাঙ্ক...কিছু নিয়েই চিন্তা ভাবনা করতে হয়না। আমি বাঙ্গাল। আমার কোন 'দেশের বাড়ি' নেই বলে মনে খুব দুঃখ । কিন্তু আপাততঃ আমার এদেশি কিছু বন্ধুদের মত বিঘে বিঘে জমির মালিক না হওয়ার এবং rootless হওয়ার দুঃখ ঘুচে গেছে । আমি আমার খামার সম্পর্কে ভয়ানক যত্নশীল। ফসল লাগিয়ে সময়মত সেগুলিকে কেটে ফেলি। পারতপক্ষে আমার ফসল নষ্ট হয়না। যে এক-দুইবার হয়েছে, আমি মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছি।
একইরকমভাবে আমি আমার ক্যাফে এবং আমার অ্যাকুয়ারিয়মকেও খুব ভালোবাসি। সময়মত উনুন থেকে না সরালে রান্না করা খাবার নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক সময়ে খেতে না দিলে ছোট মাছগুলি মরে যায়। খাবার বিক্রি করে পয়সা জমিয়ে জমিয়ে আমি আমার ক্যাফেটাকে বেশ বড় বানিয়ে ফেলেছি। সেটাকে মনের মতন করে সাজিয়েছি। অ্যাকুয়ারিয়মটাকেও নানারকমের গাছপালা দিয়ে সাজিয়েছি।
খেলতে শুরু করার সময়েও ভাবিনি আমি এত বেশি উতসাহিত হয়ে পড়ব গেমগুলিকে নিয়ে। আজকাল দিনের প্রায় বেশ কিছুটা সময় এই খেলাগুলির পেছনে চলে যায়। নিজেই নিজের উতসাহ দেখে অবাক হয়ে যাই। ভেবে দেখেছি, আমার এই গেমগুলিকে ভাললাগার এবং ভালবাসার মূল কারণ হল এই গেমগুলির বিশেষ চরিত্র। এই গেম গুলির মজা হল, এগুলি কোন লড়াই, দৌড়, শত্রুপক্ষ ধ্বংস, অজানা গ্রহের ভয়ঙ্কর প্রানী, কামান , গোলাগুলি, রক্তপাত ইত্যাদি নিয়ে নয়। বরং বাগান ভরা সবুজ ফসল ফলিয়ে নিজের অন্যঅন্য খেলুড়েদের সংগে এক সুস্থ এবং পসিটিভ খেলায় মেতে ওঠা। এই খেলাগুলিতে অন্য খেলুড়েরা শত্রু নয়, তারা হল 'পড়শি' [neighbor]। পড়শির সঙ্গে আর কে লড়াই করে? বরং, এই খেলাগুলিতে পড়শিকে সাহায্য করে টাকা এবং পয়েন্ট পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে তাদেরকে নানা জিনিষ উপহার দেওয়া যায়, তাদের কাছ থেকে নানা উপহার পাওয়াও যায়। সব মিলিয়ে এক উষ্ণ, বন্ধুত্বপূর্ণ, গঠনমূলক পরিবেশ - আমাদের চেনা পরিচিত, বহুল প্রচলিত গেমিং কনসোল এর টান টান উত্তেজনার থেকে বহুদূর। আর সেইজন্যই বোধ হয়, ফার্মভিল পৃথিবীর জনপ্রিয়তম অনলাইন গেমগুলির মধ্যে একটি। এই মূহুর্তে সারা পৃথিবীর 68,075,283 জন মানুষ নিয়মত ফার্মভিল খেলেন। সেইসব মানুষদের মধ্যে আমর মত বহু মানুষও আছেন নিশ্চয়, যারা কোন এক সময়ে কোন রকম গেমস খুলেও দেখতেন না। বেশ কিছুদিন আগে জাপানে নির্মিত একটি গেম সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলাম, যেখানে একজন মা এবং তার দুই কিশোরী মেয়েকে খেলুড়ে [রা] একলা বা একসাথে ধর্ষণ করতে পারে। এই গেমটি আমাজম ডট কমে বিক্রি করা হচ্ছিল, কিন্তু আমাজন সেটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিছুদিন আগে খবরে শোনা গেছিল এই গেমটি ভারতে চোরাপথে বিক্রি হচ্ছে। এইরকম গেম নাকি জাপানে খুব জনপ্রিয় এবং অনেক তৈরি হয়। এই ধরনের গেম যখন তৈরি এবং বিক্রি হয়, তখন নিশ্চয়ই এইধরনের গেমের নিজস্ব বাজার আছে। কিন্তু আমার মত একজন সাধারন, শান্তিপ্রিয়, জীবনমুখী মানুষের কাছে, এহেন সুস্থ ভাবনা চিন্তার পরিপন্থী গেমগুলির থেকে ফার্মভিল বা ফিশভিল কিন্তু চারিত্রিকভাবে অনেকাংশে এগিয়ে।
- Details
তেসরা মে, ২০০৯, রবিবার। ২০০৯ সালের , এমনকি বাংলা ১৪১৬ সালেরও প্রথম কালবৈশাখী এল কলকাতায়। চৈত্র- এবং বৈশাখ মাস এই বছর কলকাতাবাসীদেরকে , বলা যাতে পারে পুরো পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বুঝিয়েছে "প্রখর দাবদাহ" কাকে বলে !কিন্তু আজ দুপুরে ফিরে এল সেই বহু পরিচিত, বহু আকাংক্ষিত দৃশ্য। চারিদিক অন্ধকার করে, সূর্যের মুখ ঢেকে দিয়ে, ধূসর মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। হু হু করে উত্তর দিক থেকে ধেয়ে এল ঠাণ্ডা হাওয়া। শুকনো ধুলো উড়ল পাক খেয়ে খেয়ে। বারান্দার তারের জামা-কাপড়গুলোকে যেন কোন শক্তিশালী দৈত্য টেনে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইল। ছুটে গিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করার আগেই আমার ঘরে ঢুকে পড়ল দস্যু হাওয়া। উড়িয়ে নিয়ে গেল খবরের কাগজ, রুমাল আর দিনমানের গ্লানি। সত্যি সত্যি এসে গেল কালবৈশাখী।
আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, সেই সময়ে কালবৈশাখী হলে মাঝে মাঝে শিলাবৃষ্টি হত। বৃষ্টিতে ভিজে সেই সাদা সাদা ন্যাপথলিনের বলের মত ঠাণ্ডা বরফের গুলি গুলোকে কুড়োনোর মধ্যে আনন্দ ছিল যত, তার চেয়ে বেশি ছিল প্রকৃতির ভয়ঙকর সৌন্দর্য কে অনুভব করার এক নাম না জানা শিহরন।
একবার, আমি যখন অষ্টম শ্রেনীতে পড়ি, ১৯৮৮ সালে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। দুপুরবেলা ঘন্টাদুয়েক ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ল, আর তার সাথে হল শিলা বৃষ্টি। এত -এত-এত শিলা পড়ল, যে, সেগুলি আমাদের স্কুলবাড়ির দেওয়ালের ধার ঘেঁসে বরফের স্তূপের মত জলে গেল। স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম চারদিকের মাঠঘাট জুড়ে চাপচাপ বরফের স্তূপ। আমাদের সাদামাটা গড়ানে মফস্বল যেন হটাত হয়ে পড়েছে সিমলা পাহাড়, অথবা দার্জিলিং। সেইবার এত শিলা জমেছিল যে তিনদিন ধরে সেগুলো একটু একটু করে গলেছিল। আমাদের বাড়ির পেছন দিকের বাগানের দরজা খোলা যায়নি সে কয়দিন।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর দৌলতে আজকাল আর শিলাবৃষ্টি তো দূরঃস্থ, কালবৈশাখীরই খবর পাইনা। কলকাতা শহরে বসে তো এমনিতেও ঋতু পরিবর্তনের খবর বিশেষ পাওয়া যায়না। শহরের ইঁট-কাঠের ফ্রেমের মধ্যে ব্যালকনিতে রাখা মরসুমি ফুল বা ঘরের কোনের শৌখিন ইন্ডোর প্ল্যান্ট এর মধ্যেই যেন সাজিয়ে রাখা প্রকৃতির উদাহরণ। কিন্তু যখন আজকের মত একেকটা দিন আসে, তখন যেন হটাত করে বুঝতে পারি প্রকৃতির ক্ষমতা, তার বিশালত্ব। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুহাত বাড়িয়ে দুরন্ত কালবৈশাখীকে আবাহন করতে করতে নতুন করে, আরেকবার করে অনুভব করি প্রকৃতির তুলনায় নিজের ক্ষুদ্রতা, নিজের অপারঙ্গমতা।
স্কুলে পড়তে হয়েছিল মোহিতলাল মজুমদারের কবিতা 'কালবৈশাখী। সেই সময়ে পুরোটা মানে বুঝতাম না, এখন বুঝি। সেই কবিতার প্রথম দশটি পংক্তি যেন আজ প্রত্যক্ষ করলাম আরেকবার -
"মধ্য দিনের রক্ত নয়ন অন্ধ করিল কে?
ধরনীর পরে বিরাট ছায়ার ছত্র ধরিল কে?
কানন-আনন পান্ডুর করি জলস্থলের নিঃশ্বাস হরি
আলয়ে-কুলায়ে তন্দ্রা ভুলায় গগন ভরিল কে?
আজিকে যতেক বনস্পতির ভাগ্য দেখিযে মন্দ
নিমেষ গনিছে তাই কি তাহারা সারি-সারি নিঃস্পন্দ
মরুত পাথারে বারুদের ঘ্রান এখনি ব্যাকুলি তুলিয়াছে
প্রান পশিয়াছে কানে দূর -গগনের বজ্র-ঘোষোণ ছন্দ"
[অনেকদিন আগে মুখস্থ করা, বই হাতের কাছে নেই, তাই যতিচিহ্ণ ভুল হতে পারে]