১৯৮২ সালের বৈশাখের শুরুতে ছোটপিসির বিয়ে হল। আমি তখন ক্লাস টু। মোটে ক্লাস টু হলেও, এই বিয়েটার প্রায় শুরু থেকে শেষ অবধি বহু কাজের মধ্যে মা কিংবা বাবার হাত ধরে উপস্থিত থাকতাম বলে প্রায় সিনেমার মত অনেক কিছুই মনে আছে। আরও বেশি মনে আছে কারণ বিয়ের মধ্যেই পড়ে গেছিল আমার পরীক্ষা। নতুন পিসেমশাই হিন্দুস্থান কেব্ল্স্ -এর কারখানাতেই চাকরি করেন, আর পিসেমশাই-এর আদিবাড়ি আসানসোল সংলগ্ন ধাদকাতে, তাই আমাদের হিন্দুস্থান কেব্ল্স্ এর ছোট্ট দুই কামরার কোয়ার্টারই হল বিয়েবাড়ি। আমাদের সব আত্মীয়স্বজন এসে উপস্থিত হলেন হিন্দুস্থান কেব্ল্স্-এই। সারা পাড়ার প্রত্যেকটা কোয়ার্টারের সামনের ঘরটা ওই কয়দিন বিয়েবাড়ির জন্য বরাদ্দ ছিল। বরযাত্রী বসার জায়গা খুব সম্ভবত হয়েছিল পাড়ার মুখের প্রাইমারি স্কুলে। আর বিয়ের আসর আমাদের গায়ে লাগা কোয়ার্টারের চিত্তমামা-সর্বানীমামীর বাগানে।
সেই সব সিপিয়া দিনকালে, চৈত্র-বৈশাখে নিয়ম মেনে কয়েকদিন পরে পরেই অবিকল মোহিতলাল মজুমদারের বিখ্যাত কবিতাটার বিবরণ অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়েই কালবৈশাখী হত। তাই এই বৈশাখী বিয়েতেও যে বৃষ্টি হবেই, এটাও ধরে নেওয়া হয়েছিল। বাগানের মাটি ঘাস ছেঁটে , সমান করে বিয়ের জায়গা তৈরি হবে এটা তো স্থির। কিন্তু যতই ভালো করে প্যান্ডেল বানানো হোক, এপাশ-ওপাশ থেকে জল গড়িয়ে এসে মাটি তো ভিজবেই। মুছে যাবে বিয়ের আসরের আল্পনা। তাহলে উপায়?
উপায় বের করেছিলেন আমার মা। আমলাদহি বাজারের চেনা কাপড়ের দোকান থেকে নিয়ে আসা হল তাদের বাতিল করা, ছেলেদের শার্ট-প্যান্টের ফেব্রিক জড়িয়ে রাখার সরু, লম্বা কার্ডবোর্ডের ( আমরা বলতাম 'পিজবোর্ড') ফালি। চারখানা এমন মেটে রঙা বোর্ডের ওপর সাদা ফেব্রিক রং দিয়ে মা এঁকে ফেলেছিলেন অস্থায়ী আলপনা। একইরকম নকশা ভরা চারটে টুকরোর ফ্রেম দিয়ে তৈরি বর্গক্ষেত্রের মাঝে বসবে মঙ্গলঘট ও অন্যান্য সামগ্রী।
'আপসাইক্লিং', 'রিসাইক্লিং', 'বেস্ট আউট অফ ওয়েস্ট', 'ওয়েডিং প্ল্যানার' ইত্যাদি ঝাঁ চকচকে শব্দগুলির সঙ্গে সেসময়ে কেউ পরিচিত ছিল না। শুধুমাত্র সম্ভাব্য সমস্যার সমাধানের উপায় খুঁজে বের করেছিলেন মা। বিয়ের দিন বৃষ্টি হয়েছিল কিনা আমার মনে নেই ।
এর পরে বহু বহু দিন অবধি, ওই চারখানা বোর্ড প্রায় অনাদরেই রয়ে গেছিল আমাদের বাড়ির কোন আলমারির মাথায়, কখনও দাঁড় করানো থেকেছে কোনো তাকের ওপর, ধুলোময়লা আটকাতে গায়ে তাদের জড়ানো নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গে পাওয়া বিনামূল্যের প্লাস্টিকের মোড়ক। উনচল্লিশ বছর পেরিয়ে এসে, চারটের মধ্যে বেঁচেবর্তে রয়ে গেছে সাকুল্যে একখানা। মা'কে গত বেশ কিছু বছর ধরে বলে আসছি, এটাকে বাঁধিয়ে রাখব, দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখব, সেটাও আজ অবধি হয়ে ওঠেনি।
এই বোর্ডটা যেন একটা টাইম মেশিন, মুখোমুখি হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাশি রাশি মুখ...মূহুর্ত...ফেলে আসা সময়ের চালচিত্র।